অনলাইন সংস্করণ
১১:৩৪, ১৪ আগস্ট, ২০২৫
সংক্ষিপ্ত সুরাগুলোর মাঝে সুরা কুরাইশ এমনভাবে আলোকিত হয়ে আসে- যা তার চিরন্তন আহ্বান ও আত্মায় গভীর প্রভাব দিয়ে হৃদয়কে স্পর্শ করে। অল্প কিছু শব্দ হলেও সেগুলো প্রাণে সজীবতা আনে, অন্তরে কৃতজ্ঞতা ও লজ্জাশীলতার অনুভূতি জাগায়। এ সুরায় আল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু কুরায়শের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মে সফরের। অতএব, এরা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি এদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন ও ভীতি হতে এদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা কুরাইশ)।
এই আয়াতগুলো হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে ও তার দৃষ্টি খুলে দেয় দুটি মহান অর্থের দিকে- এক. ক্ষুধার পর খাদ্যপ্রাপ্তি। দুই. ভয়ের পর নিরাপত্তা প্রাপ্তি। নিঃসন্দেহে এ দুটিই সম্মানজনক জীবনের প্রধান স্তম্ভ। যে এগুলো পেয়ে গেছে, সে দুনিয়ার এমন দুটি অমূল্য ধন পেয়েছে, যার কোনো দাম হতে পারে না। ক্ষুধার সময় খাদ্য শুধু আহার নয়, বরং জীবন দান। এটি এমন এক রুটি- যা শরীরকে দাঁড় করিয়ে দেয়, এক ফোঁটা পানি- যা প্রাণকে সজীব করে তোলে, এমন উষ্ণতা- যা প্রয়োজনের শীতকে ঢেকে দেয় ও এমন মর্যাদা- যা দারিদ্র্যের ক্ষত সারায়। মানুষ যখন তা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন শুধু তার পেটই ক্ষুধার্ত হয় না, বরং তার মর্যাদা ক্ষুধার্ত হয়, তার মানবিকতা শুকিয়ে যায়।
এটি সেই শান্তি- যা পুরো জীবনকে ঢেকে রাখে, রাতের সেই প্রশান্তি যা প্রাণকে স্বস্তি দেয়, মায়ের বুকে সন্তানের নিশ্চিন্ত ঘুম ও ভবিষ্যতের প্রতি সেই আস্থা যে কাল ভয় নিয়ে আসবে না। মানুষ রাতে ঘুমায়, কোনো ভয়ের দুশ্চিন্তা তাকে জাগায় না; সকালে ওঠে, কোনো উদ্বেগ তার মনকে ভারী করে না।
নিরাপত্তা এমন এক নেয়ামত যার কাছে তা থাকে, সে এর মূল্য ততক্ষণ বোঝে না, যতক্ষণ না দেখে অন্য কারও কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভয় যখন কোনো ভূমিতে জায়গা করে নেয়, তখন ঘুম হারাম হয়ে যায়, স্বস্তি হারিয়ে যায়, দিন হয়ে ওঠে নরকসম, আর রাত হয় অবিরাম দুঃস্বপ্ন। আসল সুখের রহস্য ও স্থায়ী আনন্দের উৎস হলো, নিরাপত্তাপূর্ণ সেই মানসিক প্রশান্তি যা কেনা যায় না। এটি মানুষের জন্য অন্যতম বড় নেয়ামত। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ‘তোমাদের মধ্যে যে সকালে জেগে দেখে সে তার ঘরে নিরাপদ, দেহে সুস্থ ও তার কাছে দিনের খাবার আছে, সে যেন পুরো দুনিয়াই পেয়ে গেছে।’ (তিরমিজি : ২৩৪৬)।
এই তিন নেয়ামত একসঙ্গে মিললে মানুষ অভিযোগহীন হয়ে যায়। অন্যের হাতে যা আছে তার দিকে আর তাকায় না- এক. হৃদয়কে শান্ত রাখার মতো নিরাপত্তা। দুই. জীবনযাপনে সহায়তা করার মতো সুস্থতা। তিন. প্রয়োজন মেটানোর মতো খাদ্য। তাই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি এদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন ও ভীতি হতে এদেরকে নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা কুরাইশ : ৩-৪)।
এই আয়াতের মধ্যে কোমল অথচ দৃঢ় আহ্বান রয়েছে যে, একমাত্র সেই মহান সত্তার ইবাদতে মনোযোগী হও, যার হাতে সবকিছু। সব নেয়ামত আসে শুধু তাঁর ভাণ্ডার থেকে, সব ভয় দূর হয় শুধু তাঁর রহমতে। যিনি কুরাইশকে ক্ষুধার পর খাবার দিয়েছেন, চারদিক থেকে রিজিক এনে দিয়েছেন, তিনিই ভয় থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা করেছেন এবং কাবা শরিফের মর্যাদায় তাদের সুরক্ষিত করেছেন। এই নেয়ামতগুলো তাদের শক্তি বা দক্ষ পরিকল্পনার ফল ছিল না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে একেবারে খাঁটি অনুগ্রহ, যা তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা দাবি করে।
সম্পূর্ণ শোকরের অংশ হলো, নেয়ামতকে অবহেলা না করা, বরং তাকে মান্য করা; অনুগ্রহকে ভুলে না যাওয়া, বরং তা সংরক্ষণ করা। প্রকৃত কৃতজ্ঞতা শুধু মুখের কিছু কথা নয়, বরং এটি হৃদয়ের স্বীকৃতি দিয়ে শুরু হয়, জিহ্বার আন্তরিক উচ্চারণে প্রকাশ পায় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৎকর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কারণ তিনিই সব অনুগ্রহের মালিক।
শোকরের অংশ এটাও যে, নেয়ামতের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য করা, এর মাধ্যমে তাঁর অবাধ্যতা না করা; এর স্থায়িত্ব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা এবং নেয়ামতে নিমজ্জিত হয়ে অমনোযোগী হয়ে না যাওয়া। যে ক্ষুধার পর খাবার পাওয়া ও ভয়ের পর নিরাপত্তার মূল্য বুঝে, যারা তা থেকে বঞ্চিত তাদের অবস্থা অনুভব করে, খাদ্যহীন মানুষের কষ্টে ব্যথিত হয় ও নিরাপত্তাহীন মানুষের ভোগান্তিতে কষ্ট পায়, সে আসলেই কৃতজ্ঞতার মানে বোঝে।
এই প্রসঙ্গে, ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের কথা স্মরণ করে আমাদের চোখ ভিজে ওঠে। তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা আজকাল যন্ত্রণার শ্বাসরোধে কাতর। খাদ্যের তীব্র সংকট, নিরাপত্তার অনুপস্থিতি ও এমন এক সংকোচিত দৃশ্যপট সেখানে বিরাজমান যেখানে শ্বাস নেওয়াও কঠিন। সেখানকার ক্ষুধা চরমে পৌঁছে গেছে, যেন ধারালো তলোয়ার ঝুলছে সেই গলার ওপর- যা ব্যথায় অবসন্ন। তাদের শরীর ও গলা শুকিয়ে গেছে তৃষ্ণা ও বঞ্চনায়।
এই দুঃখ-কষ্টের বিপরীতে সাড়া দেয়, সেসব জীবন্ত হৃদয় ও উদার প্রাণ, যারা এখনও দানের আসল অর্থ বোঝে। তারা বিশ্বস্ত ও সরকারি অনুমোদিত মাধ্যমের সহায়তায় খাবার, ওষুধ ও পানি পৌঁছে দেয় ক্ষুধায় জর্জরিত এমন লোকদের কাছে যাদের কাছ থেকে জীবনের ন্যূনতম উপকরণও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এটাই সেই মুহূর্ত যখন সততা পরীক্ষা হয়, নিয়ত যাচাই হয়। তাই আমাদেরও উচিত এতে অংশ নেওয়া। আর এও গোপন নয় যে, এই বরকতময় আরব দেশের নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের প্রভাবশালী উপস্থিতি ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা ও সম্মানজনক অবস্থান নিয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে ধারাবাহিক উদ্যোগের মাধ্যমে, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষা ও তাদের স্থিতিশীলতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)।
দোয়ার দরজা কখনও বন্ধ হয় না এবং আন্তরিক নিয়ত এমন এক কাজ যা বৃথা যায় না। সুন্দর কথা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। আর গাজা ও ফিলিস্তিনের মানুষের অবস্থা মনে করিয়ে দেওয়া অন্তরকে জাগ্রত করে। প্রত্যেকেরই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী করণীয় আছে। যে অনুভূতি জাগ্রত করল, সে অংশ নিল; যে হৃদয় দিয়ে দোয়া করল, সে সহায়তা করল; যে স্মরণ করাল, সে পৌঁছে দিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো কাছেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দিই।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)।
তুমি যদি শুধু গভীর রাতের একটি আন্তরিক দোয়া ছাড়া কিছুই না পার, তাহলে তাই করো। তাদের জন্য দোয়া করো, যেমন তুমি চাও সংকটের সময়ে তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য দোয়া করা হোক। হে আল্লাহ, তুমি তাদের জন্য হও, তাদের সঙ্গে থাকো, তাদের কাউকে তোমার ছাড়া আর কারও হাতে ছেড়ে দিও না।
অসহায়দের হে দয়ালু প্রতিপালক, হে বিপদাপন্নদের সহায়ক, হে দ্রুত দোয়া কবুলকারী, হে অশেষ ক্ষমাশীল, তুমি আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের সহায়, সাহায্যকারী, ভরসা ও শক্তি হও। হে আল্লাহ, তারা ক্ষুধার্ত হয়েছে, তুমি তাদের তৃপ্ত করো; তারা ভীত হয়েছে, তুমি তাদের নিরাপদ করো; তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তুমি তাদের ঐক্যবদ্ধ করো; তারা দুর্বল হয়েছে, তুমি তাদের শক্তি দাও। হে আল্লাহ, তারা তোমার ছাড়া কারও ওপর নির্ভর করতে পারে না, তোমার রহমত ছাড়া কোনো শক্তি তাদের নেই। তুমি তাদের ক্ষুধা দূর করো, ভয় দূর করো। হে আল্লাহ, তুমি তাদের ভাঙা মন জোড়া লাগাও, তাদের মৃতদের রহম করো, অসুস্থদের সুস্থ করো, নিখোঁজদের ফিরিয়ে দাও; আর তাদেরকে স্বাস্থ্য ও প্রশান্তির পোশাক পরিয়ে দাও। হে সবার চেয়ে বেশি দয়ালু, তুমি তাদের প্রতি তোমার বিশেষ দয়া করো।
(১৪-০২-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ০৮-০৮-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)