ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সম্পদের যথাযথ মূল্যায়নের গুরুত্ব

সম্পদের যথাযথ মূল্যায়নের গুরুত্ব

দুনিয়ার জীবনে চলতে গেলে সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটা আল্লাহর অনন্য ব্যবস্থাপনা। তিনিই একে আমাদের জীবনের বাহ্যিক অবলম্বন বানিয়েছেন। এর সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার যদি না করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন তাঁর দেওয়া নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা হবে, আবার আমাদের পার্থিব জীবনের অবলম্বনও নষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি (আমার নেয়ামতের) কৃতজ্ঞতা আদায় কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে (জেনে রেখ) আমার শাস্তি অবশ্যই অত্যন্ত কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য এ বিশ্বাস ধারণ করা যেমন জরুরি, আমার এ সম্পদ আমার আল্লাহ আমাকে দয়া করে দান করেছেন, তেমনি এর ব্যয়ক্ষেত্রও হতে হবে আল্লাহর বিধানমাফিক। অপ্রয়োজনে যেমন এ সম্পদ উড়ানো যাবে না, তেমনি অবৈধ প্রয়োজনেও তা ব্যয় করা যাবে না। নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হলে উভয় দিকই অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।

আল্লাহ সম্পদের প্রকৃত মালিক : দুদিনের এ জীবনে আল্লাহ আমাদেরকে খুবই সামান্য কিছু সম্পদের মালিক বানিয়েছেন। জগতের সেরা ধনী যে, সে-ই বা কতটুকু সম্পদের অধিকারী? সচেতন বা অবচেতনভাবে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান যত নেয়ামত আমরা ভোগ করি, কারো পক্ষে কি এর এক ক্ষুদ্র অংশেরও বিনিময় আদায় করা সম্ভব? জগতের যা কিছু, সবই তো আল্লাহর। তিনিই প্রকৃত মালি। ঈমানদার যে কেউ এ বিশ্বাস পোষণ করে। অল্প সময়ের জন্য তিনি কিছু সম্পদের বাহ্যিক মালিকানা আমাদের দান করেছেন। এ মালিকানা পরিবর্তনও হয়। এক হাত থেকে আরেক হাতে যায়। পথের ভিখারি রাজা হয়। রাজা সর্বস্ব হারিয়ে পথে নামে। চারপাশে এ বাস্তবতা দেখার পরও আমরা মালিকানাধীন সম্পদকে প্রকৃত অর্থেই আমাদের সম্পদ মনে করে ভুল করি। এ থেকেই সৃষ্টি হয় অপচয়ের মানসিকতা। আমার টাকা আমার ইচ্ছামতো খরচ করব, এতে কার কী বলার আছে! অথচ আল্লাহ সতর্ক করেছেন, ‘তোমরা তাদেরকে (অর্থাৎ তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের) আল্লাহর সম্পদ থেকে দান কর; যা তিনি তোমাদের দান করেছেন।’ (সুরা নুর : ৩৩)। এ আয়াতের প্রেক্ষাপট ও আলোচ্য বিষয় ভিন্ন। তবে আল্লাহ মানুষকে যে সম্পদ দান করেছেন, এ আয়াতে তা ‘আল্লাহর সম্পদ’ বলে আলোচিত হয়েছে। কথায় কথায় আমরাও বলি, এসব আল্লাহর দান, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ। কিন্তু শুধু মৌখিক স্বীকার নয়, বরং মোমিন হিসেবে এর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস থাকাও অপরিহার্য। এ সম্পদ একদিকে যেমন আল্লাহর নেয়ামত, আবার তা আমাদের হাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানতও। তাই এর যথাযথ ব্যবহার না করলে, অযথা-অপ্রয়োজনে নষ্ট করলে, অপচয় করে বেড়ালে আমানতের খেয়ানতকারী হিসেবে জবাবদিহিতার মুখেও পড়তে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন কিছু বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগে কোনো বান্দার পা-ই নড়বে না। তা হলো- তার জীবন সে কীসে ব্যয় করেছে, তার জ্ঞান অনুসারে সে কী আমল করেছে, তার সম্পদ সে কোত্থেকে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে আর তার শরীর কীসে নষ্ট করেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।

সম্পদ ব্যয়ে মালিকের অনুমতির প্রয়োজনীয়তা : নিজে কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শারীরিক আরাম বিসর্জন দিয়ে অর্থ উপার্জন করলেই তাতে নিজের যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকার সৃষ্টি হয় না। এ সম্পদ যেহেতু আমাদের হাতে আমানত, তাই এর পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণও আমাদের দায়িত্ব। এখানে স্বেচ্ছাচারের কোনো সুযোগ নেই। খরচ করতে চাইলে যিনি এর প্রকৃত মালিক, তার অনুমতিক্রমেই তা খরচ করতে হবে। অন্যথায় কেয়ামতের ময়দানের প্রশ্নোত্তর পর্বে আটকে যেতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি বিষয়কে অপছন্দ করেন- ১. অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করা বা না জেনে ধারণা করে কথা বলা, ২. সম্পদ নষ্ট করা, ৩. অধিক প্রশ্ন করা।’ (বোখারি : ১৪৭৭)। বোঝা গেল, সম্পদ নষ্ট করা আল্লাহর কাছে একটি ঘৃণ্য বিষয়। এ সম্পদ যখন তিনি মানুষকে আমানত হিসেবে দিয়েছেন, তা দিয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে বলেছেন, তা যদি নষ্ট করা হয়, অনর্থক খরচ করা হয়, তাহলে তিনি তা অপছন্দ করবেনই। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে সম্পদরূপী এ নেয়ামতের কদর অবশ্যই করতে হবে।

অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে সতর্কতা : অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় যে কোনো বিষয়ই ইসলাম অপছন্দ করে। অহেতুক কথা, অহেতুক কাজ, অহেতুক ব্যয়- বর্জনীয় সবই। হাদিসের ব্যাপক নির্দেশনা হলো, ‘ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য- এর অনুসারীরা অনর্থক সব কিছু বর্জন করবে।’ (তিরমিজি : ২৩১৮)। এর মর্ম হচ্ছে, প্রয়োজন ছাড়া মুসলমান কোনো কাজই করতে পারে না। প্রয়োজনটা যেমনই হোক, উপকারিতা এর থাকবেই। তবে আরেকটি শর্ত হলো, প্রয়োজনীয় কাজ এবং এর পদ্ধতিও অবশ্যই শরিয়তের বিবেচনায় বৈধ হতে হবে। অবৈধ কাজ বা অবৈধ পন্থা যত প্রয়োজনীয়ই হোক, তা করা যাবে না। আমাদের হাতে থাকা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ও আমানত এ ধনসম্পদ ব্যয় করতে গেলে দুটি বিষয় অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। তা হলো- ব্যয়ের খাতটা প্রয়োজনীয় কি না এবং প্রয়োজনটা বৈধ প্রয়োজন কিনা। তাহলেই অপচয়ের ভয়াবহতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আবার প্রয়োজন পূরণ হয় কতটুকুতে, তাও অবশ্য লক্ষণীয়। হাদিসের ভাষ্যানুসারে, নদীর পারে বসেও যদি কেউ ওজু করে, তবুও অপ্রয়োজনীয় পানি ব্যয়ের অনুমতি তার নেই। এটাও অপচয়।

অপচয় এড়ানোর নাম কার্পণ্য নয় : অপচয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ এই নয় যে, কার্পণ্যে জড়িয়ে যেতে হবে। অপচয়ের মতো কার্পণ্যও মানবচরিত্রের এক মন্দ দিক। ইসলাম জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ শিক্ষা দেয়, তেমনি সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, অপচয় ও কার্পণ্যকে দুই পাশে রেখে এর মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কোরআনে আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের কিছু পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে। সেখানে তাদের সম্পদ ব্যয়ের নীতি উল্লিখিত হয়েছে এভাবে, ‘যখন তারা ব্যয় করে, অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এ দুয়ের মাঝে মধ্যমপন্থায়।’ (সুরা ফোরকান : ৬৭)। তাই কেবল ব্যয়সংকোচন নয়, বরং ব্যয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। যেখানে যা প্রয়োজন, তা ব্যয় করতে হবে।

লেখক : ইসলাম বিষয়ক গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সম্পদ,ব্যবস্থাপনা,ইসলাম
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত