ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলাম ও নারী

ইসলাম ও নারী

প্রাক-ইসলামি যুগে নারী অধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত, শোষকের অত্যাচারে যখন নারীরা ব্যাকুল, তখন পৃথিবীতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শুভাগমন হয়। তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ঘনীভূত অন্ধকার চিরে আলোকিত হলো পৃথিবী। তার স্বর্গীয় বার্তার সামনে জালেমের কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধ হলো, সকল নির্যাতন দূর হলো। রহমতের নবী নিয়ে এলেন শান্তির অমীয় বাণী। স্পষ্ট ও নির্ভিক কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘নারী কেনাবেচার বস্তু বা শুধু ভোগ্যসামগ্রী নয়।’ মহানবী (সা.)-এর এ বাণী নারীকে স্পর্শ করেছে তার জীবনের সকল স্তরে। তিনি আরও ঘোষণা করলেন, ‘শিশুকন্যা হত্যা করো না। ইসলামে এটি জঘন্য অন্যায়। এতিমণ্ডঅনাথদের স্বার্থ রক্ষা কর। তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ তিনি অবাধ বিয়েবন্ধন বন্ধ করলেন। রচনা করলেন সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক ও তালাকের নীতিমালা। সামাজিক শান্তির জন্য ব্যাভিচারকে নিষিদ্ধ করলেন। সন্ন্যাসবাদ প্রতিরোধ করে বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করলেন। নারী-পুরুষের সমতা ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠা করলেন তাদের উত্তরাধিকার। পিতার ওপর কন্যার লালন-পালন, স্বামীর ওপর স্ত্রীর ভরণ-পোষণকে বাধ্যতামূলক করলেন।

নারীর উন্নয়নে বিপ্লব : রাসুলুল্লাহ (সা.) বিয়ের পর স্বামীর ওপর স্ত্রীর মোহর আরোপ করলেন। স্ত্রীকে প্রয়োজনে তালাক দেওয়ার অধিকার, পুনরায় গ্রহণ, পুনর্মিলন ও পুনর্বিয়ের জন্য নির্ধারণ করলেন কতগুলো নির্দিষ্ট নীতিমালা। তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারীকে দিলেন ন্যায্য অধিকার। পুরুষের সঙ্গে তাদেরও দিলেন সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও আইনগত অধিকার। এভাবে নারীজাতির উন্নয়নে আনলেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাদের কল্যাণে রাখলেন অবিস্মরণীয় অবদান। সৃষ্টি করলেন নতুন অধ্যায়। উন্মুক্ত করলেন নব দিগন্তের। ফলে নারীজাতি পেয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকার। অবমাননা ও লাঞ্ছনার গ্লানি থেকে তাদের ইজ্জত-আব্রু রক্ষা পেয়েছে। আধুনিক বিশ্বে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা কি আদৌ পেরেছে, নারীদের উন্নয়নে মহানবী (সা.)-এর দেখানো জীবনব্যবস্থার সামান্যও বাস্তবায়ন করতে? তারা কি পেরেছে নারীদের ন্যায্য অধিকার দিতে?

নারীর প্রতি সুবিচার : ইসলাম যুদ্ধের ময়দানে বৃদ্ধা ও শিশুদের ন্যায় নারীদের হত্যা করাকে নিষিদ্ধ করেছে। মিলন ছাড়া ঋতু ও প্রসূতিকালে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা ও মেলামেশা বৈধ করেছে। তাদের সঙ্গে সে সময় কোনো প্রকার বৈষম্য করাকে ইসলাম সমর্থন করে না, যেমনটি জাহেলি যুগে কিছু সম্প্রদায়ের লোক করত। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ঋতুকালীন অবস্থায় একটি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। ওই পাত্রেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পানি পান করতে দিলে তিনি তা দিয়েই পান করতেন। এমনকি পাত্রের যে স্থানে আমি আমার মুখ লাগাতাম, তিনি ঠিক সে স্থানেই মুখ রাখতেন।’ (সুনানে নাসায়ি : ৩৭৮)। তিনি আরও বলেন, ‘ঋতুকালীন সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কোলে হেলান দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করতেন।’ (বোখারি : ২৯৭)।

নারীর অধিকার রক্ষা : জিহাদ, হিজরত ও ইজারার ক্ষেত্রে ইসলাম নারীদের অধিকার সমুন্নত রেখেছে। যেভাবে পুরুষরা হিজরত করেছে, অনুরূপভাবে নারীরাও হিজরত করার সুযোগ পেয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কাছে মোমিন নারীরা হিজরত করে এলে তোমরা তাদের পরীক্ষা করে দেখ। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে অধিক অবগত। এরপর যদি তোমরা জানতে পার, তারা মোমিন, তাহলে তাদের আর কাফেরদের কাছে ফেরত দিও না। তারা কাফেরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফেররাও তাদের জন্য হালাল নয়। তারা যা ব্যয় করেছে, তা তাদের ফিরিয়ে দাও। তোমরা তাদের বিয়ে করলে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না, যদি তোমরা তাদের তাদের মোহর দাও। আর তোমরা কাফের নারীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রেখ না। তোমরা যা ব্যয় করেছ, তা ফেরত চাও। তারা যা ব্যয় করেছে, তা যেন তারা চেয়ে নেয়। এটা আল্লাহর বিধান। তিনি তোমাদের মাঝে ফয়সালা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মুমতাহিনা : ১০)।

মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ : পুরুষের মতো নারীদেরও মতামত দেওয়া ও পরামর্শ দেওয়ার অধিকার রয়েছে ইসলামে। যখন তারা কোনো গ্রহণযোগ্য মতামত দেবে, তখন তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রী খাদিজা (রা.) থেকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ চাইলে তিনি তাকে বলতেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ আপনাকে কখনও অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক সমুন্নত রাখেন, সত্য কথা বলেন, অসহায় মানুষের সহায়তা করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং অধিকার বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সাহায্য করেন।’ (বোখারি : ৩, মুসলিম : ৪২২)।

নারীকে অধিক মর্যাদা দান : ইসলাম নারীদের শুধু পুরুষের মতোই সমান মর্যাদা দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি; বরং ইসলাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের চেয়েও অধিক মর্যাদা দিয়েছে। আল্লাহ কোরআনে নারীদের নামে একটি সুরা নাজিল করেছেন। নারী যখন মা হয়, তখন সন্তানের জন্য জান্নাতকে তাদের পায়ের তলে রেখেছেন। আর ইসলাম নারীদের সঙ্গে সদাচরণ করার জন্য উপদেশ দিয়েছে তিনবার; আর পুরুষদের প্রতি দিয়েছে একবার। কোনো নারী সন্তান প্রসবের সময় মারা গেলে সে শাহাদতের মর্যাদা লাভ করে। আধুনিক বিশ্বে নারী স্বাধীনতার নামে নগ্নতা, ব্যভিচার, বিজ্ঞাপনের মডেল, ফ্যাশন শো চলছে। এ সুযোগে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকরা নারী স্বাধীনতার নামে ভোগ-বিলাসের নিষ্প্রাণ পণ্যে পরিণত করে নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে অবাধ যৌনাচার। হাজার হাজার মেয়ে হচ্ছে কুমারী মাতা। দেখা দিচ্ছে ঘাতকব্যাধি ‘এইডস’। এর নামই কি নারী স্বাধীনতা?

নারীজাতির মুক্তির দিশারী মহানবী (সা.) তাদের ভাগ্যোন্নয়নে বিদায় হজে ঘোষণা করলেন মুক্তিসনদ। কোরআনে নারীদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে রয়েছে বিস্তারিত আলোচনা। মহানবী (সা.)-এর অমীয় বাণী হাদিসেও রয়েছে নারী অধিকারের বিস্তারিত বর্ণনা। যার দৃষ্টান্ত ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সত্যিই সর্বকালে সর্বযুগের নারীজাতির সব সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে মহানবী (সা.) উপস্থাপিত ‘ইসলাম’। তার নির্দেশিত জীবনব্যবস্থার অনুকরণই একমাত্র দিতে পারে নারীজাতির উন্নয়নের গ্যারান্টি।

লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ

ইসলাম,নারী
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত