
ইসলামে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে, যারা অবনত হয়।’ (সুরা বাকারা : ৪৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘সব নামাজের প্রতি যত্নবান হও; বিশেষ করে, মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সঙ্গে দাঁড়াও।’ (সুরা বাকারা : ২৩৮)। অনুরূপভাবে রাসুল (সা.)-এর অসংখ্য হাদিসেও নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মালেক ইবনে হুয়াইরিস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের বলেছেন, ‘তোমরা এমনভাবে নামাজ আদায় কর, যেমন আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখ।’ (সুনানে কোবরা, বায়হাকি : ৩৮৫৬)।
নামাজের ফজিলত : নামাজ এক মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতময় আমল। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে অশ্লীল কর্মকাণ্ড ও গর্হিত কার্যাবলি হতে নিবৃত্ত থাকা যায়। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করার ফলে পাপ মোচন হয় ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে পাক-পবিত্র হয়ে কোনো ফরজ নামাজ আদায় করার জন্য হেঁটে আল্লাহর ঘর মসজিদে যায়, তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি পাপ ঝরে যায় এবং অপরটির বদৌলতে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।’ (মুসলিম : ১৪০৭)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘বলো তো, যদি তোমাদের কারও বাড়ির সামনে একটি নদী থাকে, আর সে তাতে রোজ পাঁচবার গোসল করে, তাহলে কি তার দেহে কোনো ময়লা থাকবে?’ তারা বললেন, ‘তার দেহে কোনোরূপ ময়লা থাকবে না।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘এ হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের উদাহরণ। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দার গোনাহগুলো মোচন করে দেন।’ (বোখারি : ৫২৮)।
নামাজের নির্দেশ দান : নিজে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে হবে। সেই সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবার-পরিজনকেও নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিতে হবে। বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন, ‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদের নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন।’ (সুরা তহা : ১৩২)। বিশ্বনবী (সা.)-ও সন্তানসন্ততি এবং পরিবার-পরিজনকে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার জোর তাগিদ দিয়েছেন। আমর ইবনে শোআইব (রহ.) পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদের নামাজের জন্য নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স ১০ বছর হয়ে যাবে, তখন নামাজ আদায় না করলে তাদের প্রহার করবে এবং তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দেবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯৫)।
নামাজের সময় : মুসলমানদের ওপর যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে, সেগুলোর জন্য সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই নামাজ আদায় করা বাঞ্ছনীয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মুসলমানদের ওপর নামাজ ফরজ।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। হাদিস শরিফেও নামাজের সময়ের নির্দেশ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জোহরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় যখন সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে এবং মানুষের ছায়া তার দৈর্ঘ্যের সমান হয়। আর আসরের নামাজের সময় না হওয়া পর্যন্ত তা থাকে। আসরের নামাজের সময় থাকে সূর্য বিবর্ণ হয়ে সোনালি বা তাম্রবর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত। মাগরিবের নামাজের সময় থাকে সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা গোধূলি বা পশ্চিম দিগন্তে উদ্ভাসিত লালিমা অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত। ইশার নামাজের সময় থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আর ফজরের নামাজের সময় ফজর বা ঊষার উদয় থেকে শুরু করে সূর্যোদয় পর্যন্ত।’ (মুসলিম : ১২৭৫)।
সর্বপ্রথম হিসাব নামাজের : নামাজ আদায় করা ও না করার ওপর মুসলমানদের পারলৌকিক সফলতা ও ব্যর্থতা বহুলাংশে নির্ভর করে। যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করবে, তারা সফল হবে ও মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে যারা নামাজ আদায় না করবে, তারা ব্যর্থ হবে। কেননা, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব হবে নামাজের। যারা প্রথম হিসেবে আটকে যাবে, তাদের সফলতা ও মুক্তির পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন বান্দার কাজসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। যদি ঠিকমতো নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে, তবে সে নাজাত পাবে ও সফলকাম হবে। যদি নামাজ নষ্ট হয়ে থাকে, তবে সে ব্যর্থ ও বিপর্যস্ত হবে। যদি ফরজ নামাজের মধ্যে কিছু কমতি হয়ে থাকে, তবে মহান আল্লাহ বলবেন, ‘দেখ! বান্দার কোনো নফল নামাজ আছে কি না।’ থাকলে তা দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে।’ (তিরমিজি : ৪১৩)।
কুফরি তুল্য পাপ : নামাজ বর্জন করা এক ভয়ংকর অপরাধ ও কুফরি তুল্য পাপ। নামাজ মুসলমানিত্বের পরিচয় বহন করে। পক্ষান্তরে নামাজ বর্জন কাফেরদের সাদৃশ্য তুলে ধরে। আজান দেওয়ার পর কোনো কাফের নামাজ আদায় করতে যায় না। তাই নামাজের সময় কোনো মুসলমানও যদি নামাজ আদায় না করে কিংবা মসজিদে না যায়, তাহলে কাফেরদের সঙ্গে তার এক ধরনের সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। এ কারণেই হাদিস শরিফে নামাজ বর্জনকে কুফরি তুল্য পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হলো নামাজ।
সুতরাং যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দেয়, সে কুফরি কাজ করে।’ (তিরমিজি : ২৬২১)। এ কারণেই হানাফি, শাফেয়ি ও মালেকি মাজহাব মতে বিনা ওজরে নামাজ বর্জনকারীকে পাপিষ্ঠ ফাসেক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর হাম্বলি মাজহাব মতে অকারণে নামাজ বর্জনকারী ব্যক্তিকে কাফের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বোপরি নামাজকে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপক বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। জাবের (রা.) বলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ছেড়ে দেওয়া। (মুসলিম : ১৪৮)।
নামাজ বর্জনের পরিণাম : নামাজ বর্জন করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। যারা বিনা ওজরে নামাজ বর্জন করবে, তাদের জন্য রয়েছে নিদারুণ নরকের যন্ত্রণা। জান্নাতের অধিবাসী লোকেরা জাহান্নামিদের জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের কীসে জাহান্নামে আবদ্ধ করেছে?’ তারা বলবে, ‘আমরা নামাজ পড়তাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৪২-৪৩)। তাই নামাজ আদায়ে যত্নবান হতে হবে এবং আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার মানসে নামাজ পালনে ব্রতী হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ সেসব নামাজির, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বেখবর; যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে।’ (সুরা মাউন : ৪-৬)। যেসব লোক নামাজ আদায় করে না, তাদের হাশর-নশর বড় বড় কাফের বেঈমানের সঙ্গে হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একদিন নামাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ে যত্নবান থাকে, কেয়ামতের দিন এ নামাজ তার জন্য নুর এবং হিসাবের সময় দলিল ও নাজাতের কারণ হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ে যত্নবান হবে না, কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নুর, দলিল ও নাজাতের কারণ হবে না; বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সঙ্গে তার হাশর হবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৪৬৭)।