
দৃষ্টিশক্তি আল্লাহতায়ালার অমূল্য নেয়ামত। এর সদ্ব্যবহার জীবনে আনে ছন্দ, গতি আর প্রশান্তি। সংযত দৃষ্টির ফলে গড়ে ওঠে সুন্দর মনের পরিশীলিত প্রজন্ম। মানুষের মনোজগৎ ও আচরণে লাগে পরিশুদ্ধিতার নির্মল ছোঁয়া। এতে সুস্থ সুন্দর জীবনাচারের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। পরিবার হয়ে ওঠে সুখ-শান্তির নীড়। পক্ষান্তরে বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ব্যক্তিকে বানায় অপাংক্তেয় এবং সমাজকে করে দূষিত। কুদৃষ্টি ঈমানি আভা নিভিয়ে জ্বেলে দেয় অশান্তির দাবানল। তাইতো অধুনা নাটের গুরু সব নষ্ট গণমাধ্যমে অবাধে চলছে নোংরামি, কদর্যতা ও নির্লজ্জতার হিরিক। পশ্চিমা সভ্যতা ও তাদের দোসরদের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে সব নোংরামির পথ-পন্থা উন্মুক্ত করা এবং মুক্ত চিন্তার নামে সর্বত্র নষ্টামির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া। যেন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে পশ্চিমাদের শিকারে পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহ। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বকীয়তা এবং কালজয়ী ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে নিক্ষিপ্ত হয় লয়-ক্ষয় ও পতনের চোরাবালিতে।
কুদৃষ্টি শয়তানের বিষাক্ত তীর : কুদৃষ্টি ইবলিশের বিষাক্ত তীর; যা সে সুশোভিত করে মানুষের হৃদয়ে বিদ্ধ করে এবং এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় গোটা দেহজুড়ে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি যৌন লালসা চরিতার্থ করার মানসে কাতরাতে থাকে বারবার। তাই অপাত্রে অনিচ্ছায় হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিতে হবে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে হঠাৎ দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘(দৃষ্টি পড়ামাত্র) তুমি তোমার চোখ ফিরিয়ে নেবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২১৪৮)। বুরাইদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে তিনি আরও বলেছেন, ‘হে আলী, (কোনো নারীর দিকে) পরপর দু’বার তাকাবে না। কেননা, প্রথমবার তোমার জন্য বৈধ হলেও দ্বিতীয়বার বৈধ নয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২১৪৯)।
অসংযত দৃষ্টির ভয়াবহ ক্ষতি : আধুনিক বিশ্বের গবেষণা ও অনুসন্ধান দ্বারাও প্রমাণিত যে, চোখের হেফাজত স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। বিপরীতে চোখের খেয়ানত রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ। কেননা, যারা দৃষ্টি সংযত রাখে না, তারা অশ্লীল ছবি দেখে পরকীয়া, মাস্টারবেশন, ব্যভিচারের মতো জীবন বিধ্বংসী পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের শরীরে দানা বাঁধে এইডস, যৌন অক্ষমতা, প্র¯্রাবের সমস্যা, ধাতু ক্ষয়, চোখের সমস্যা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা এবং প্রোটেস্ট গ্রন্থির বৃদ্ধির মতো নানাবিধ জঘন্য রোগ-ব্যাধি। এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে অল্পতেই। তাদের স্বভাব-প্রকৃতি এবং আচার-আচরণও হয়ে পড়ে অস্বাভাবিক, ভারসাম্যহীন। ফলে তারা অসহনীয় দুঃখ-বেদনার গ¬ানি বয়ে বেড়ায় জীবনভর। অব্যক্ত জ্বালা-যন্ত্রণা তাদের কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত। আনন্দের সব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও তাদের দেখা যায় নিরানন্দ, বিষন্ন। চোখের খেয়ানত মানুষের আত্মিক প্রশান্তি ও মানসিক স্বস্তি উধাও করে দেয়। নিঃসন্দেহে দৃষ্টির অপব্যবহার নিজ পায়ে কুঠারাঘাত এবং নিজেকে ধ্বংস করার নামান্তর। কোরআন মাজিদে দয়াময় আল্লাহ এ ঘৃণ্য কাজ থেকে আমাদের কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেন, ‘নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৯৫)।
দৃষ্টির সদ্ব্যবহার জান্নাত লাভের সোপান : চোখের হেফাজতের অনেক উপকারিতা রয়েছে; রয়েছে বহু আকর্ষণীয় পুরস্কার। যারা দৃষ্টির হেফাজত করে, তারা যেমনিভাবে রাজাধিরাজ রবের প্রিয় পাত্র হন, তেমনি শ্রদ্ধার পাত্র হন আপামর জনসাধারণের কাছেও। দৃষ্টির সংযত ব্যবহার জান্নাত লাভেরও সোপান। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমাকে ছয়টি ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলে আমি তোমাদের জান্নাতের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেব। তা হলো- কথা বললে সত্য বলবে, প্রতিশ্রুতি দিলে রক্ষা করবে, আমানত রাখলে ফেরত দেবে, যৌনাঙ্গের হেফাজত করবে, দৃষ্টি সংযত রাখবে এবং তোমার হাত সংবরণ করবে (তথা ক্ষমতার অপব্যবহার ও জুলুম করবে না।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২৮০৯)।
সংযত দৃষ্টিতে স্বর্গীয় স্বাদ : নজরের হেফাজত মানবমনে বাড়িয়ে দেয় আল্লাহপ্রেমের মাত্রা। তার অন্তরাত্মাকে করে শক্তিশালী, মনকে রাখে প্রফুল্ল আর হৃদয়কে করে আলোকিত। দৃষ্টি সংযম ব্যক্তির কলবে প্রতিফলিত হয় আল্লাহর নুর। আর নুরছাওয়া ব্যক্তির দিকেই ধাবিত হয় যাবতীয় কল্যাণের ফল্গুধারা। সংযত দৃষ্টি মানবমনে আলোর ফুল ফোটায় পরম মমতায়।
শয়তানের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে দেয় দারুণ সাহসিকতায়। সোনার হরফে লেখার মতো একটি চমৎকার উক্তি রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করে চলে, শয়তান তার ছায়াকেও ভয় করে।’ তা ছাড়া দৃষ্টিপাতের গণ্ডি সীমিত থাকলে তনুমন থাকে সুস্থির। ফলে সমাহিত চিত্তে নিজের জন্য উপকারী বিষয়াশয় নিয়ে যেমন ভাবার সুযোগ হয়, তেমনি উম্মাহর কল্যাণ চিন্তায় নিজেকে জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ করারও সময় হয়। আর মোমিন দৃষ্টি সংযমের দ্বারা ইবাদতে যে স্বর্গীয় স্বাদ আস্বাদন করে, তার কি কোনো তুলনা আছে ভঙ্গুর এ পৃথিবীর আমোদণ্ডফুর্তিতে? আবু উমামা বাহেলি (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীর সৌন্দর্যের প্রতি (অনিচ্ছাকৃত) নজর পড়ে যাওয়ার পর প্রথমবারেই (সঙ্গে সঙ্গে) দৃষ্টি অবনত করে ফেলে, আল্লাহতায়ালা তাকে এমন ইবাদত করার তৌফিক দেন, যার মিষ্টতা (স্বাদ) সে হৃদয়ে অনুভব করে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২২৭৮)।