ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অনুপম আদর্শ

ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অনুপম আদর্শ

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতির জন্য তিনি ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অনুপম আদর্শ। অন্ধকার আরবে তিনি জ্বালিয়েছেন আলোর দীপ্ত মশাল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য তিনি লালন করতেন উদার দৃষ্টিভঙ্গি। বিচারের ক্ষেত্রে বংশের উচ্চতা, প্রভাবের উষ্ণতা, স্বজনপ্রীতির দুর্বলতা- কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ইনসাফের কষ্টিপাথরে খাঁটি মানুষে পরিণত করতে তিনি উম্মতের প্রতি রেখে গেছেন অনুসরণীয় আদর্শ। ইনসাফের পথে উম্মতকে উদ্দীপ্ত করতে এরশাদ করেছেন, ‘যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা নিজের আরশের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।’ তারপর আরশের ছায়ায় আশ্রয়প্রাপ্ত সাত প্রকার মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম ন্যায়পরায়ণ শাসকের কথা উল্লেখ করেন। (বোখারি : ৬৬০)।

সমাজের পরতে পরতে শান্তির স্নিগ্ধ বাতাস প্রবাহিত করতে নবীজি (সা.)-এর দিকনির্দেশনার বিকল্প কিছু নেই। তাঁর কালজয়ী কথামালা উম্মাহর মুক্তির রাজপথ। উম্মাহকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে তিনি বলেছেন, ‘ন্যায় বিচারকগণ কেয়ামাতের দিন মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপার্শ্বে নূরের মিম্বরগুলোয় বসা থাকবেন। তাঁর উভয় হাতই ডান হাত। যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে সুবিচার করে।।’ (মুসলিম : ১৮২৭)।

ন্যায়পরায়ণতার সীমানা জীবনের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে জীবনের মোড়ে মোড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার কার্যক্রম, দণ্ডবিধি কার্যকর, সংক্ষুব্ধ দুটি দলের মাঝে ফায়সালা, পরিবার ও সমাজের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা ও আচরণসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। নবীজির (সা.) ইনসাফময় জীবনে উল্লেখ করার এবং শিক্ষাগ্রহণের মতো হাজারো ঘটনা রয়েছে। একবার চুরির অপরাধে মাখজুম গোত্রের এক মহিলার হাত কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। নবীজির স্নেহধন্য উসামা (রা.) নবীজির কাছে মহিলার হাত না কাটার জন্য বিশেষ সুপারিশ করেন। নবীজি তার সুপারিশ বাতিল করে যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, আসুন তা হজরত আয়েশা (রা.)-এর ভাষায় শুনি। তিনি বলেন, ‘মাখজুম গোত্রের এক মহিলার চুরির ঘটনা কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল, এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তারাই উত্তরে বলল, একমাত্র রাসুলের প্রিয় উসামা বিন জায়েদ (রা.) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা নবীজির সঙ্গে কথা বললেন। প্রস্তাব শুনে নবীজির চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে গেল। নবীজি বললেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?

উসামা নবীজিকে বললেন, আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন হে নবীজি। অতঃপর সন্ধ্যাবেলায় নবীজি খুতবায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করে বললেন- তোমাদের পূর্বের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তা হলে আমি অবশ্যই তাঁর হাত কেটে দিতাম। তারপর নবীজির নির্দেশে ওই মহিলার হাত কেটে ফেলা হলো। আয়েশা (রা.) বলেন, অতঃপর মহিলা খাঁটি তওবা করে বিয়ে করল। সে যখন আমার কাছে আসত, আমি তার প্রয়োজন নবীজির কাছে উপস্থাপন করতাম।’ (বোখারি : ৬৭৮৬)।

পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে আপন হলো তার পরিবার। জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সর্বক্ষেত্রে মিশে থাকে পরিবার নামক বটবৃক্ষের ছায়া। জন্মের দিন থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিরাম সফর করেও এই বটবৃক্ষের ছায়া আমরা অতিক্রম করতে পারি না। পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি ঝলমল করে জীবনের আকাশে। রক্তপরম্পরায় গড়ে ওঠা এই সম্পর্কে কৃত্রিমতার ঠাঁই নেই। তাই পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার অমোঘ বাঁধনে জড়িয়ে থাকে আমরণ। প্রিয় নবীজি (সা.) পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।? প্রত্যেকের হক ইনসাফের পাল্লা দিয়ে পূরণ করতেন। কারও হক আদায়ের ব্যাপারে উদাসীনতা প্রদর্শন করতেন না। বিষয়টি আয়েশা (রা.)-এর কথায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে, পরিবারের সদস্যদের প্রতি নবীজির ইনসাফের নমুনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফভিত্তিক বণ্টন করে বলতেন, হে আল্লাহ, এটা আমার পক্ষ থেকে ইনসাফ, যেটুকু আমার সম্ভব হয়েছে। আর যা আপনার নিয়ন্ত্রণে এবং আমার সাধ্যের বাইরে সে জন্য আমাকে অভিযুক্ত করবেন না।’ (আবু দাউদ : ২১৩৪)। হাদিসের ‘যা নিয়ন্ত্রণে সে জন্য আমাকে অভিযুক্ত করবেন না’ এই বাক্য দ্বারা নবীজি (সা.) হৃদয়ের ভালোবাসার কথা উদ্দেশ্য নিয়েছেন। কারণ স্ত্রীদের ভরণপোষণ, রাত্রি বণ্টন ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমতার বিধান রক্ষা করা সম্ভব হলেও ভালোবাসার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করার বিষয়টি আয়ত্তের বাইরে। তাই নবীজি আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করেছেন।

বাহ্যিক অধিকারের বিষয়গুলোতে পরিবারের সদস্যদের মাঝে ইনসাফ রক্ষা করা অতীব আবশ্যক। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির দুজন স্ত্রী রয়েছে, কিন্তু সে একজনের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে যায়, তা হলে কেয়ামতের দিন এক পার্শ্ব ভাঙা অবস্থায় উপস্থিত হবে।’ (তিরমিজি : ১১৪১)।

পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ইনসাফ রক্ষায় মানুষের অক্ষমতার বিষয়টি আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে বলেন, ‘তোমরা যতই ইচ্ছা করো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি কখনোই সমান ব্যবহার করতে পারবে না; তবে তোমরা কোনো একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না ও অপরকে ঝোলানো অবস্থায় রেখো না।’ (সুরা নিসা : ১২৯)।

ইনসাফের মানদ- প্রতিষ্ঠা করতে এভাবেই তিনি ব্যক্তিগত ইচ্ছা-আগ্রহকে বিসর্জন দিতেন। উল্লিখিত হাদিসগুলো দ্বারা নবীজির উদারতা, পরিবারের প্রতি ইনসাফভিত্তিক দায়িত্ববোধ, কোমল আচরণ এবং তাদের হকের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির আচরণগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। নিরাপদ ও শান্তিময় পরিবার গঠনে নবীজির শিক্ষণীয় জীবন থেকে উৎকৃষ্ট কিছু নেই।

ইনসাফ,প্রতিষ্ঠা,আদর্শ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত