
আল্লাহতায়ালা আসমানি কিতাবের মধ্যে কোরআনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। কোরআনে আগের সব কিতাবের উত্তম শিক্ষা একত্র হয়েছে ও এমন অনেক পূর্ণতা আছে- যা অন্য কিতাবে ছিল না। এজন্য কোরআন সেসব কিতাবের সাক্ষী, রক্ষক ও বিচারক। যে কিতাবকে কোরআন সত্য বলে প্রমাণ করে, সেটিই আল্লাহর কিতাব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি এটার আগের অবতীর্ণ কিতাবের প্রত্যয়নকারী ও সংরক্ষকরূপে।’ (সুরা মায়িদা : ৪৮)। আসমান থেকে কোরআনের চেয়ে হেদায়েতময় আর কোনো কিতাব নাজিল হয়নি। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া সবচেয়ে সুন্দর বাণী। কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসুলের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘কোরআন তো তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্য সম্মানের বস্তু; তোমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা জুখরুফ : ৪৪)।
আল্লাহ কোরআনকে বলেছেন মহিমান্বিত, সম্মানিত ও শক্তিশালী। তিনি মানুষের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, তারা যেন এর মতো কিতাব, বা দশটি সুরা, এমনকি একটি সুরাও রচনা করে দেখায়। কিন্তু কোরআনের ভাষাশৈলী, বাগ্মিতা, গঠন ও ভঙ্গি এতটাই অনন্য যে এটি মানুষের সাধ্যের বাইরে। সুসাহিত্যিক ও বাগ্মী আরবরা পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে, এর সঙ্গে মানুষের কোনো রচনার তুলনা হয় না। কোরআন কবিতা নয়, গদ্যও নয়, চিঠি নয়, বক্তৃতাও নয়, বরং এটি আল্লাহর এক বিশেষ বাণী। এর আয়াতগুলো একসঙ্গে দৃঢ়, সুন্দর, শক্তিশালী ও কোমল। বড় বড় আরব কবি ও বাগ্মীরাও এর অতুলনীয়তা স্বীকার করেছে। কুরাইশের প্রভাবশালী কবি ও বাগ্মী ওয়ালিদ ইবনু মুগীরা বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে কবিতা, অনুপ্রাস, কাসিদা এমনকি জিনদের কবিতার ব্যাপারে আমার মতো জানাশোনা আর কেউ নেই। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা.) যা বলছেন, তা এসব কিছুর সঙ্গে মিলে না।’ এরপরও আল্লাহতায়ালা কোরআনকে এমন সহজ করে দিয়েছেন যে, মানুষ তা পাঠ করতে ও বুঝতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্যে; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ (সুরা কামার : ১৭)।
কোরআন সত্য-মিথ্যার ফয়সালাকারী। এতে আছে ঈমান-আকিদা, শরিয়তের বিধান, আখলাক, গল্প, খবর, উপদেশ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-সাফল্যের পথনির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এই কোরআন সৎপথের দিশারী; যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি প্রত্যাখ্যান করে, এদের জন্যে রয়েছে অতিশয় মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা জাসিয়া : ১১)।
কোরআনের বিস্ময় কখনো শেষ হয় না, এর মুজিজাগুলোকে মানুষের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। আয়াতুল কুরসি কোরআনের শ্রেষ্ঠ আয়াত। এটি পাঠ করলে বান্দাকে আল্লাহর হেফাজত ঘিরে রাখে, শয়তান কাছে আসতে পারে না। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন তুমি শয়ন করতে বিছানায় যাও তখন আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে। এতে যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি শায়িত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষাকারী তোমার সঙ্গে থাকবে ও সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বোখারি : ৩২৭৫)।
সুরা ফাতেহার প্রথম তিনটি আয়াত পড়লে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল, মহিমা বর্ণনা করল ও আমার পবিত্র ঘোষণা করল।’ (মুসলিম : ৭৬৪)। আর যে সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।’ (মুসলিম : ১৭৬৮)। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে উপকারী দোয়া হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে সাহায্য চাওয়া। আর তা সুরা ফাতিহার মধ্যেই আছে যে, ‘আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি ও তোমারই সাহায্য চাই।’ (সুরা ফাতিহা : ৫)।
দুটি ছোট সুরা- সুরা ফালাক ও সুরা নাস- রাতে নাজিল হয়, যেগুলোর মতো আর কিছু নাজিল হয়নি। এগুলোতে মানুষের জন্য খারাপের হাত থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা শেখানো হয়েছে। কোরআনের আয়াত রোগেরও চিকিৎসা। একবার সাহাবিরা একটি স্থানে ছিলেন, তখন এক নারী এসে বলল, ‘আমাদের নেতা সাপের কামড়ে অসুস্থ, তোমাদের মধ্যে কেউ কি ঝাড়ফুঁক করতে জানো?’ তখন একজন সাহাবি সুরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করলে তিনি ভালো হয়ে যান। (বোখারি)। কোরআনের তেলাওয়াত মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলে। এর আয়াত পড়ে ও শুনে মানুষ কাঁদে।
কোরআন মানুষের মন কেড়ে নেয়। এটি ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়। আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘হিজরতের আগে আবু বকর (রা.) তার বাড়ির আঙিনায় একটি মসজিদ বানিয়েছিলেন। তিনি সেখানে নামাজ পড়তেন ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তখন মুশরিকদের নারী ও বাচ্চারা দাঁড়িয়ে তা শুনত, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। আবু বকর (রা.) ছিলেন খুব কান্নাকাটিকাতর মানুষ; কোরআন পড়লে তার চোখে পানি আসত। এতে মুশরিকরা ভয় পেল যে, তাদের নারী-সন্তানরা ইসলাম গ্রহণ করবে।’ (বোখারি : ৩৯০৫)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি কোরআন পাহাড়ের ওপর নাজিল হতো, তবে সেটি ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যেত আল্লাহর ভয় থেকে। তাই মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরআনকে ভীতি ও বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করতে। কোরআনের আয়াত সাহাবাদের জীবন বদলে দিয়েছিল। যখন মদ হারাম করা হলো এবং আয়াত নাজিল হলো, ‘অতএব, তোমরা কি নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা মায়েদা : ৯১)। তখন উমর (রা.) বললেন, ‘আমরা থেমে গেলাম, আমরা থেমে গেলাম।’ আর মদগুলো রাস্তার পথে ঢেলে দেওয়া হলো।’ (মুসলিম : ৫০২৫)।
কোরআনের আয়াত ঈমান বাড়িয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন এর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।’ (সুরা আনফাল : ২)। কোরআনের মর্যাদা এত বড় যে, এর প্রতিটি হরফ পড়ার জন্য সওয়াব পাওয়া যায়, আর প্রতিটি সওয়াব দশ গুণ হয়ে যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি হরফ পড়বে, সে একটি সওয়াব পাবে, আর একটি সওয়াব দশগুণ হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৯১০)। কোরআনে অসংখ্য ধনভাণ্ডার আছে। তাই সাহাবায়েকেরাম এর কিছুই মিস করতে চাইতেন না। উমর (রা.) বলেছেন, ‘আমি আর আমার এক আনসারি প্রতিবেশী পালা করে নবীর কাছে যেতাম। একদিন সে যেত, আরেকদিন আমি যেতাম। যে যেত, সে ওই দিনের সব খবর ও অহি ফিরে এসে অন্যজনকে জানিয়ে দিত।’ (বোখারি : ৮৯)।
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা তাদের কিতাব মেনে চলত, তারা কোরআন নাজিল হওয়ায় আনন্দিত হয়েছিল; কারণ তাদের কিতাবেও এর সত্যতার প্রমাণ ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, তারা যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আনন্দ পায়।’ (সুরা রাদ : ৩৬)। কোরআন হলো এমন এক অলৌকিক গ্রন্থ, যা মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সত্য নবুয়তের প্রমাণ। নবীজির মৃত্যুর পরও এই মুজিজা কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীকে তাঁর যুগের প্রয়োজন মুতাবিক কিছু মুজিজা ?দান করা হয়েছে, যা দেখে লোকরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে। আমাকে যে মুজিজা দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে, ওহি যা আল্লাহ আমার ?প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। কাজেই আমি আশা করি, কেয়ামতের দিন তাদের অনুসারীদের অনুপাতে আমার অনুসারীদের সংখ্যা অনেক ?অধিক হবে।’ (বোখারি : ৪৯৮১)। আল্লাহ নিজেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কোরআন সংরক্ষণ করার। এটি কখনও বিকৃত হবে না। মহানবী (সা.) এক খুতবায় বলেছেন, ‘আমার রব আমাকে শিখিয়েছেন, আজ আমি যা জেনেছি তা তোমাদেরও জানাতে।’ আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ এমন একটি কিতাব নাজিল করেছেন, যাকে পানি ধুয়ে মুছে ফেলতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৬৩৯)। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এটি মানুষের হৃদয়ে সংরক্ষিত থাকবে, সময়ের সাথে কখনো হারিয়ে যাবে না।’
মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর সাহাবারা ওহি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কেঁদে ছিলেন। একদিন আবু বকর (রা.) উমর (রা.)-কে বললেন, ‘চল, আমরা উম্মে আইমানের কাছে যাই, যেমন- নবী (সা.) তাঁর কাছে যেতেন।’ তারা সেখানে গেলে উম্মে আইমান (রা.) কেঁদে ফেললেন। তারা বললেন, ‘আপনি কেন কাঁদছেন? আল্লাহর কাছে যা আছে, তা রাসুল (সা.)- এর জন্য উত্তম।’ তিনি বললেন, ‘আমি জানি আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্তম। কিন্তু আমি কাঁদছি এই কারণে যে, আসমান থেকে অহি আর নাজিল হবে না।’ এতে আবু বকর ও ওমর (রা.)ও কেঁদে ফেললেন।’ (মুসলিম : ৬২১২)।
কোরআনের মর্যাদার কারণে আল্লাহতায়ালা এর পাঠকদেরও উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন। নবী করিম (সা.) কোরআন পাঠকারীদের ভালোবাসতেন, তাদের বিশ্বাস করতেন ও তাদের মৃত্যুতে দুঃখ করতেন। এমনকি যারা কোরআন শিখে পড়ত, তাদের ওপর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তিনি এক মাস দোয়া করেছিলেন। আবু বকর, ওমর, উসমান ও আলি (রা.)ও কোরআন পাঠকদের বিশেষ সম্মান দিতেন। উমর (রা.) তাদের কাছাকাছি রাখতেন, সভায় অগ্রাধিকার দিতেন, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আল্লামা কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘বেশ কিছু সাহাবি নবীর জীবদ্দশাতেই পুরো কোরআন মুখস্থ করেছিলেন, কারণ তারা আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং নবী করিম (সা.) তাদের সম্মান দিয়েছিলেন।’
সুতরাং, হে মুসলমানরা, আল্লাহ কখনোই আসমান থেকে কোরআনের মতো পূর্ণাঙ্গ, বিস্তৃত, সুন্দর, মহান ও সম্মানিত কিতাব নাজিল করেননি। কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বড় অনুগ্রহ ও রহমত। যে কোরআন ও ইসলামে আনন্দ পায়, সে সবচেয়ে বড় আনন্দ পেয়েছে। এটি দুনিয়ার সমস্ত ধনভাণ্ডারের চেয়ে উত্তম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো, এটা আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়; সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।’ এরা যা পুঞ্জীভূত করে তা অপেক্ষা এটা শ্রেয়।’ (সুরা ইউনুস : ৫৮)। যে কোরআনকে ভালোবাসে, সে আল্লাহকেই ভালোবাসে। আল্লামা ইবনে কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহকে কতটা ভালোবাসো, তা বুঝতে চাইলে দেখ- তুমি কোরআনকে কতটা ভালোবাসো ও কোরআন শুনে কতটা আনন্দ পাও।’ সত্যিকারের সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে কোরআন শিখতে ও শিখাতে ব্যস্ত থাকে। আর সফল সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কোরআনের সম্মান ও কোরআন পাঠকারীদের সম্মান করতে বেছে নিয়েছেন।