ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অহংকার ও আত্মপ্রদর্শনের পরিণতি

অহংকার ও আত্মপ্রদর্শনের পরিণতি

দুনিয়া যখন কারও দিকে আসে, তখন তাকে পরীক্ষা করে; আর যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন কষ্ট দেয়। যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, তখন তা নষ্ট হয়ে যায়; যখন প্রশস্ত হয়, তখন দংশন করে; আর যখন আনন্দ দেয়, তখনই দুঃখ দেয়। কবি বলেছেন, ‘দুনিয়ার অবস্থা হলো, কখনও ক্ষমতার পালা, কখনও দুরবস্থা; আর জীবন হলো, কখনও সুস্থতা, কখনো অসুস্থতা।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বল, পার্থিব ভোগ সামান্য আর যে মুত্তাকি তার জন্য পরকালই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’ (সুরা নিসা : ৭৭)।

পরহেজগার ও আল্লাহভীরু মানুষরা আল্লাহর নেয়ামতে আনন্দিত হয়। তারা সেই আনন্দ কৃতজ্ঞতা, স্মরণ ও প্রশংসার মাধ্যমে প্রকাশ করে। তারা সম্পদ পেয়ে অহংকারী হয় না, ধন-সম্পদে মত্ত হয় না। সুখে তারা বাড়াবাড়ি করে না, দুঃখে হতাশ হয় না। কিন্তু যারা বিলাসী, উদ্ধত ও অপব্যয়ী তারা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতে গর্ব করে, মানুষের সঙ্গে দাম্ভিকতা দেখায়। তাদের অভ্যাসই হলো অহংকার, দম্ভ ও বড়াই করা। তারা পোশাক-পরিচ্ছদে, বাহারি জিনিসে, পশু-সম্পদে ও সন্তান-সংখ্যায় প্রতিযোগিতা করে। নিজেদের স্তরের লোকদের ছোট মনে করে, গরিবদের ওপর প্রাধান্য দেখায় ও দুর্বলদের হৃদয় ভেঙে দেয়। এটাই গর্ব ও অহংকারে ভরা মানুষদের স্বভাব এবং জ্ঞান ও বিবেকহীন লোকদের বৈশিষ্ট্য, যারা অভাবীদের অনুভূতি বোঝে না, বিপদগ্রস্ত ও বাস্তুচ্যুতদের কষ্টে মনোযোগ দেয় না, অসুস্থ ও দুঃখীদের অবস্থার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না।

এর মূল কারণ কী? অহংকার, আত্মতুষ্টি, দুনিয়ার প্রেমে ডুবে যাওয়া, তার চাকচিক্যে প্রতারিত হওয়া, নিজের বড়ত্বে ভেসে যাওয়া ও অন্যদের হেয় ভাবা। এসবই মানুষকে বিপথে নেয়। তারা খ্যাতি ও প্রদর্শন ভালোবাসে, আনন্দে নয় বরং গর্বে মত্ত হয়। এমন কাজ শুধু সেই হৃদয় থেকেই আসে যা অহংকার, অজ্ঞতা ও অন্যায়ে ভরে গেছে এবং বিনয় ও নম্রতা সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে সে গাফেল হয়ে পড়ে, ভুলের মধ্যে পড়ে যায়, নাক উঁচু করে চলে, নিজেকে বড় মনে করে, মানুষকে তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখে, দম্ভভরে হাঁটে ও কথা বলে। শয়তান তাদের মনে একরকম দম্ভের আগুন জ্বেলে দেয়। এতে তারা সাময়িক উত্তেজনা ও আনন্দ পায়, যা তাদের অপচয় ও বেহিসাবি খরচে ঠেলে দেয়। তারা হারাম কাজে ব্যয় করে, শুধুমাত্র নাম-যশ ও লোক-দেখানোর জন্য সম্পদ নষ্ট করে, প্রতিযোগিতা ও গর্বে অর্থ নষ্ট করে ফেলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গর্ব, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সুরা হাদিদ : ২০)।

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ‘নেয়ামতের গর্ব মানে হলো, মানুষ সেই নেয়ামতের মাধ্যমে অন্যদের ছোট করে দেখা, নিজেকে তাদের চেয়ে বড় ভাবা, তাদের ওপর আধিপত্য করা এবং তাদের মনকে নিজের সম্মান ও সেবার দিকে আকৃষ্ট করা।’ যে মানুষ গর্বিত, দাম্ভিক ও আত্মপ্রদর্শনকারী সে আল্লাহর কাছেও ঘৃণিত এবং মানুষের কাছেও অপছন্দনীয়, যদিও সে বাহারি কথা বলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা লুকমান : ১৮)।

কোরআন এমন আনন্দ থেকে বহু স্থানে নিষেধ করেছে যা অহংকার, গর্ব ও আত্মতুষ্টির কারণে হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর আমি তাকে সুখ-সম্পদ আস্বাদন করাই তখন সে অবশ্যই বলবে, আমার বিপদ-আপদ কেটে গেছে, আর সে তো হয় উৎফুল্ল ও অহংকারী।’ (সুরা হুদ : ১০)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ওপর গর্ব করে, কারণ আল্লাহ তাকে বেশি দিয়েছেন।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এটা এজন্যে যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও, আর যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার জন্যে হর্ষোৎফুল্ল না হও। আল্লাহ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদের।’ (সুরা হাদিদ : ২৩)।

আজকাল গর্ব, আত্মপ্রদর্শন ও দম্ভে ভরা মানুষ আনন্দে মত্ত হয়ে যায়। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ভোজসভা, সাজানো টেবিল, দামি কার্পেট, আলিশান বাড়ি, সুন্দর বাগান, ফলভর্তি উদ্যান, ঝলমলে পোশাক, বয়ে চলা পানির ফোয়ারা, বিলাসবহুল গাড়ি ও প্রশস্ত বসার ঘরের ছবি তুলে প্রকাশ করে। সব কিছু প্রদর্শন করে যেন সবাই তাকে দেখে, চিনে, তার নাম বলে ও তার ফলোয়ার বাড়ে। কিন্তু এসব আসলে এক ধরনের হালকাপনা, গর্ব ও বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব কাজের কোনো ফল বা সুপারিশ পরকালে তার কাজে আসবে না। কত মানুষ দুনিয়ায় সম্পদ, মর্যাদা ও সংখ্যার গর্বে ভেসে গেছে; কিন্তু আজ তারা কবরের বন্দি! তাদের সেই দম্ভ ও প্রদর্শন কিছুই কাজে আসেনি; তাদের লোভ ও প্রতিযোগিতা কোনো লাভ দেয়নি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। এটা সংগত নয়, তোমরা শিগগিরই এটা জানতে পারবে; আবার বলি, এটা সংগত নয়, তোমরা শিগগিরই এটা জানতে পারবে। সাবধান! তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না। তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই; আবার বলি, তোমরা তো তা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে, এটার পর অবশ্যই সেই দিন তোমাদের নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।

বলুন তো, আজ কোথায় সেই বাড়িঘরগুলোর মালিকরা? কোথায় সেই রাজারা, প্রাসাদের সম্রাটরা? কোথায় সেই শক্তিশালী শাসক ও বীররা? কোথায় আমাদের পূর্বপুরুষরা? পিতা ও দাদা-পরদাদারা? কোথায় অসুস্থ ও তাদের দেখতে আসা মানুষগুলো? কোথায় নিজার জাতি? কোথায় ইয়ারাম, সামুদ, আর আদ জাতির লোকেরা, যারা পাহাড় কেটে ঘর বানাতো, আর দুনিয়ায় যাদের মতো কেউ সৃষ্টি হয়নি? সবাই চলে গেছে, ইতিহাসে মিশে গেছে, কবরের মাটির নিচে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। হে গর্বিত ও আত্মপ্রদর্শনকারী মানুষ! আল্লাহকে ভয় করো। নিজের ইচ্ছায় গর্ব-অহংকার ত্যাগ করো এর আগে যে, বাধ্য হয়ে তা ত্যাগ করতে হয়। তুমি আসলে একজন দাস, অসহায়, সীমাবদ্ধ এক মানুষ — উপরে নিচে সর্বত্র তুমি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে ঘেরা। তোমার জন্য অহংকার, গর্ব বা দম্ভ মোটেও শোভন নয়। কী নিকৃষ্ট সেই বান্দা, যে গর্বে ভরে যায়, নিজেকে বড় ভাবতে থাকে, আর মহান ও সর্বোচ্চ আল্লাহকে ভুলে যায়! কী নিকৃষ্ট সেই বান্দা, যে সীমালঙ্ঘন করে, অত্যাচার করে, আর সর্বশক্তিমান রবকে ভুলে যায়! কী নিকৃষ্ট সেই বান্দা, যে খেল-তামাশায় ডুবে থাকে, কবর ও মৃত্যুর কথা ভুলে যায়! কী নিকৃষ্ট সেই বান্দা, যে অহংকারী, অবাধ্য, আর নিজের শুরু ও শেষের কথা মনে রাখে না! আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তি একবার সুন্দর পোশাক পরে চলছিল, তার নিজের সাজসজ্জা দেখে সে গর্বিত হচ্ছিল। চুল ঠিকঠাক করে অহংকারভরে হাঁটছিল। তখন আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দিলেন। অতএব, সে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর গভীরে ডুবে যেতে থাকবে।’ (বোখারি : ৫৭৮৯)। মহান আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের সবাইকে অহংকার ও আত্মগর্বের পথ থেকে রক্ষা করুন, আর আমাদের পরিয়ে দিন বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ বান্দাদের পোশাক।

ইসলাম সুন্দর পোশাক পরা, ভালো যানবাহন ব্যবহার করা বা পরিচ্ছন্নভাবে জীবনযাপন করতে নিষেধ করেনি। শরিয়ত অনুমতি দিয়েছে যেন আমরা আমাদের মর্যাদা অনুযায়ী পরিপাটি পোশাক পরি, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো বাহনে চলাফেরা করি, মানুষের সঙ্গে দেখা করার সময় নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখি এবং আল্লাহ যে নেয়ামত দিয়েছেন, অহংকার, বাড়াবাড়ি, প্রদর্শন বা অন্যকে ছোট করার ভাব ছাড়াই তা প্রকাশ করি। আমর ইবনু শুআইব (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা খাও, পান করো, দান করো ও পোশাক পরো; কিন্তু যেন তাতে অহংকার বা অপচয় না থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ চান, তার বান্দার ওপর তার নেয়ামতের ছাপ দেখা যাক।’ (মুসনাদে আহমদ)। আবু আহওয়াস (রা.) বলেন, তার পিতা বলেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম, তখন আমার পোশাক ছিল জীর্ণ। নবী করিম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি সম্পদ আছে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল, আমার অনেক কিছু আছে। তিনি বললেন, তা হলে আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, তার প্রভাব তোমার ওপর দেখা যাক।’ (মুসনাদে আহমদ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহর নেয়ামত ও সম্মানের ছাপ তোমার ওপর প্রকাশ পেতে দাও।’ আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক অতিশয় সুন্দর ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে বলল, সৌন্দর্য আমার অতি প্রিয়, আর আমাকে সৌন্দর্য দান করা হয়েছে যা আপনি দেখছেন। এমনকি আমি এতটুকুও পছন্দ করি না যে, জুতার ফিতা বা তার লাল অগ্রভাগের সৌন্দর্যের দিক দিয়েও কেউ আমাকে ডিঙ্গিয়ে যাক। এটা কি অহংকার? তিনি বলেন, না। বরং অহংকার হলো সত্য থেকে বিমুখ হওয়া এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা।’ (আদাবুল মুফরাদ : ৫৫৮)। অতএব, হে মুসলমানরা, আল্লাহকে ভয় করো, কৃতজ্ঞ ও প্রশংসাকারী বান্দাদের পথ অনুসরণ করো, আর গর্ব ও আত্মপ্রদর্শনের পথে পা দিও না।

(১১-০৪-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ০৩-১০-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)

অহংকার,আত্মপ্রদর্শন,পরিণতি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত