
শীতের সকাল। কুয়াশায় ঢাকা আকাশ। নিস্তব্ধ হাওয়া। জমে যাওয়া শিশির। কিন্তু কিছু হৃদয় তখন উষ্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, তারা নামাজের সেজদায় মগ্ন। আল্লাহর স্মরণে জেগে আছে। প্রকৃত অর্থে, শীতের দিন শুধু প্রকৃতির রূপান্তর নয়; বরং ঈমানি মৌসুম, ইবাদতের শীতকাল।
রহমতের নিঃশব্দ মৌসুম : আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি রাতদিনকে দুটি নিদর্শন করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১২)। এ দিনরাতের পরিবর্তনে রয়েছে আল্লাহর রহস্য। শীতে রাত দীর্ঘ, দিন ছোট। এ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মোমিনদের জন্য এক বিশেষ সুযোগ। দীর্ঘ রাত ইবাদতের জন্য অনুকূল, সংক্ষিপ্ত দিন রোজার জন্য সহজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শীতকাল মোমিনের জন্য শীতল যুদ্ধক্ষেত্র। এর দিনে রোজা রাখা সহজ, আর রাতে নামাজ আদায়ও সহজ।’ (মুসলিম : ১৯৭৫৯)।
শীতের উৎপত্তি যার শ্বাস থেকে : অনেকে মনে করে, শীত আসে বরফের দেশ থেকে; কিন্তু ইসলামি দৃষ্টিতে শীতের উৎস আরও গভীর ও রহস্যময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নাম তার সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করল, হে রব! আমার একাংশ অন্য অংশকে গ্রাস করছে। তখন আল্লাহ তাকে দুটি নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন- একটি গ্রীষ্মে, অন্যটি শীতে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম ও শীতের কনকনে ঠান্ডা- এ দুটোই জাহান্নামের নিঃশ্বাস।’ (বোখারি : ৫৩৭, মুসলিম : ৬১৭)। অর্থাৎ শীতের কনকনে ঠান্ডা আসলে জাহান্নামের একটি নিঃশ্বাস। এ চিন্তা যখন অন্তরে আসে, তখন শীতের কষ্টে কাঁপতে থাকা মানুষ জানে- এটি শুধু প্রাকৃতিক ঠান্ডা নয়, বরং পরকালের সতর্কবার্তা। তখন ইবাদত শুধু দায়িত্ব নয়, বরং ভয় ও ভালোবাসার মিশ্র অনুভব হয়ে ওঠে।
শীতল রাতে ওজুর সওয়াব : শীতের সময় ঘুমের আরাম ছাড়তে কষ্ট হয়। কিন্তু সেই কষ্টেই লুকিয়ে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কষ্টকর অবস্থায় (যেমন- ঠান্ডা রাতে) সুন্দরভাবে ওজু করা, মসজিদে যাওয়ার জন্য বহু পদক্ষেপ নেওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের অপেক্ষা করা- এগুলোই প্রকৃত আল্লাহর পথে অবস্থান।’ (মুসলিম : ২৫১)। শীতে প্রতি ফোঁটা ঠান্ডা পানি যেন ক্ষমার ফোঁটা, প্রতিটি সেজদা যেন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির ঢাল।
রোজার সহজতা রহমতের উপহার : শীতে দিনের বেলা ছোট, তাই রোজা রাখা সহজ। সাহাবিরা এ মৌসুমে নফল রোজা বেশি রাখতেন। তারা বলতেন, ‘শীতের রোজা হলো সহজ সওয়াবের সম্পদ।’ (শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকি : ৩৫১৬)। শীতের এ সহজ রোজা মানুষকে সংযমী করে, কৃতজ্ঞ করে, আর মনে করিয়ে দেয় জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেতে রোজা এক মহা অস্ত্র।
তাহাজ্জুদের ডাক আত্মার উষ্ণতা : শীতের দীর্ঘ রাত যেন তাহাজ্জুদের জন্যই বানানো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রাতের শেষ প্রহরে তোমার রব আসমান থেকে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন। বলেন, কে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই? কে আমার কাছে কিছু চায়, আমি তাকে দিই? কে ক্ষমা চায়, আমি তাকে ক্ষমা করি?’ (বোখারি : ১১৪৫, মুসলিম : ৭৫৮)। এ আহ্বান শীতের হিম হাওয়ায় আত্মায় আগুন জ্বালায়। যখন সবাই গুটিয়ে থাকে কম্বলের নিচে, তখন যে দেহ ঠান্ডা পানি দিয়ে ওজু করে সেজদা দেয়, সে আসলে জান্নাতের পথে হাঁটে।
সহমর্মিতা ও সদকার মৌসুম : শীত শুধু নিজের উষ্ণতার সময় নয়, বরং অন্যের শীত ভাগ করে নেওয়ার সময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে বলে গণ্য হবে না, যে নিজে পরিতৃপ্ত থাকে; অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে এবং সে তা জানে।’ (বোখারি : ১১২)। শীতে একটি কম্বল, একটি গরম কাপড় কিংবা একবেলা খাবার দান করাও ইবাদতের সওয়াব। যখন কারও শীতে উষ্ণতা দেব, তখন আসলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
শীতকালে ইবাদতের তাৎপর্য : শীতের দিনে দেহ জমে; কিন্তু ঈমান যেন জমে না যায়। এ মৌসুম শেখায় ধৈর্য, সংযম ও আত্মসমর্পণ। ঠান্ডা পানি দিয়ে ওজু করা, ঘুম ত্যাগ করে নামাজে দাঁড়ানো, রোজা রাখা- সবই ইবাদতের আগুনে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। যে বোঝে- শীত এসেছে জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে, সে তখন ইবাদতে আরও আগ্রহী হয়। কারণ সে জানে, এ দুনিয়ার ঠান্ডা যদি এত কষ্টদায়ক হয়, তবে পরকালের আগুন কত ভয়াবহ হবে!