
মদিনার মসজিদে নববি। ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আজ কে রোজা রেখেছে? কে ক্ষুধার্তকে খাবার খাইয়েছে? কে রোগী দেখতে গিয়েছে?’ দেখা গেল, সবই আবু বকর করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘জান্নাতি ছাড়া কারও মধ্যে এতগুলো ভালো গুণ থাকতে পারে না।’
যখন মুসলিমরা ৩৮ জনের একটি ছোট দল, আবু বকর চাইলেন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে। অনেক অনুরোধের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) রাজি হলেন। সকলে মিলে কাবায় প্রবেশ করলেন ও বিভিন্ন কোণে অবস্থান নিলেন। প্রথমেই আবু বকর উঠে দাঁড়ালেন, উপস্থিত লোকদের ইসলামের প্রতি ডাকলেন। তিনিই প্রকাশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি আহ্বানকারীদের প্রথম।
মুশরিকরা রেগে গিয়ে আবু বকর ও অন্যান্য মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, এলোপাথাড়ি মারতে লাগল, পাথর ছুঁড়তে লাগল। আবু বকরকে মেরে শুইয়ে ফেলল। অচেতন অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। রাতে জ্ঞান ফিরে এলে প্রথমেই তিনি জানতে চাইলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) কেমন আছেন? তাঁর মা খাবার নিয়ে এলেও তিনি খেলেন না। নিজ চোখে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা না দেখা পর্যন্ত তিনি খাবেন না বলে স্থির করলেন। তখন তাকে দারুল আরকামে রাসুলুল্লাহ (সা.) কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। তার অবস্থা দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) কেঁদে ফেললেন।
আবু বকর প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নবুওয়াত লাভের পর প্রথম যাকে তিনি ইসলামের দিকে ডাকেন। ইসলামের দাওয়াত পাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অবিচল ছিলেন। তার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি। পুরুষদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র ছিলেন তিনি। জাহেলি যুগে তিনি কুরাইশদের একজন নেতা ছিলেন। পরামর্শদাতা, জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ- বিশেষ করে নসব বা বংশসংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। আবু বকর ছিলেন হালকা পাতলা গড়লের। তার তিন কন্যা ও দুই পুত্র ছিল। ছোট মেয়ে আয়েশাকে তিনি বাল্যকালেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। আর অন্য দুই কন্যা আসমা ও উম্ম কুলসুমের বিয়ে হয় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দুই সাহাবি যুবায়ের ও তালহার সঙ্গে- যারা একসঙ্গে থাকতেন ও একসঙ্গে মারা যান।
আবু বকর কখনই মূর্তিপূজা করেননি, মদপান করেননি। তিনি মনে করতেন এটা সম্ভ্রম ও বিবেচনাবিরোধী। সত্যের প্রতি তার অন্তর আগে থেকেই উন্মুখ ছিল। ইসলাম আসার পর তিনি সবকিছুর ওপর তা পছন্দ করলেন এবং সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণভাবে তাতে প্রবেশ করলেন। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবির মধ্যে পাঁচজনই তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য তিনি তার সমস্ত সম্পদ ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তা ছিল ৪০ হাজার দিনার (মতান্তরে দিরহাম)। কুরাইশদের যেসব দাসদাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দিয়ে তিনি তাদের মুক্ত করে দেন। এদেরই একজন হলেন বিলাল (রা.)- ইসলামের প্রথম মুয়াজজিন। সাহাবাদের জন্য তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত, উদার। তাবুকের যুদ্ধে তিনি তার সমস্ত সম্পদ দান করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ?’ তিনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই যথেষ্ট।’
আখেরাতের কল্যাণের কাজে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাপারে আবু বকর ছিলেন অগ্রগামী। ওমর (রা.) বলেছেন, ‘ঈমানের ক্ষেত্রে আবু বকরের ঈমান অন্য সব উম্মাতের ঈমান একত্রিত করলে যা হয়, তার চেয়ে বেশি।’ আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আবু বকর হবেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী।
আলি (রা.) বলেছেন যে, শ্রেষ্ঠ বীর হচ্ছেন আবু বকর (রা.)। বদরের যুদ্ধে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন, উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে তাঁকে পাহারা দিয়েছেন। সে সময় কাফেরদের বাহিনী ছিল মুসলিমদের তিনগুণ। এই যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী কাফের সেনাদলের মুখোমুখি হয়, রাসুলুল্লাহ (সা.) পরামর্শ চাইলে প্রথমেই দাঁড়ান আবু বকর।
আবু বকরের ছেলে আবদুর রহমান ছিলেন কুরাইশদের পক্ষের যোদ্ধা। পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে তিনি সেদিনের ঘটনা বলছিলেন। তিনি দূরে দূরে সরে থাকছিলেন যেন আবু বকর তার সামনে না পড়েন। কীভাবে তিনি তার পিতাকে আঘাত করবেন? আবু বকর শুনে বললেন, ‘আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম, সামনে পেলেই হত্যা করতাম।’ তিনি এটাই বুঝিয়ে দিলেন যে, একজন মোমিনের কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা সকল মানবিক স্নেহের ওপরে।
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতি কঠোর হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী। সেজন্য বদরের যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হলে তিনি তাদের হত্যা না করে মুক্তিপণ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। মুসলিমদের তখনকার আর্থিক অবস্থাও তার বিবেচনায় ছিল। বলা হয়েছে, বদরের সাহাবিরা সর্বশ্রেষ্ঠ, আর বদরের ফেরেশতারা অন্য ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের টিকে থাকার যুদ্ধ, সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করার যুদ্ধ। ওহুদের যুদ্ধের একপর্যায়ে সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। আবু বকরই প্রথম ফিরে এসেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে। তিনি ছিলেন রাসুলের মুখপাত্র। তার হয়ে বিভিন্ন গোত্র, প্রতিনিধি ইত্যাদির সঙ্গে কথা বলতেন।
সাহাবিদের মধ্যে কোরআনে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান ছিল তার। বিভিন্ন ঘটনায় আমরা এর প্রমাণ পাই- যার একটি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর বিভিন্ন গোত্রের জাকাত দিতে অস্বীকার করার ঘটনা। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, যে সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, যদি তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় দিত এমন একটি উটের গলার রশিও দিতে অস্বীকার করে।’ অথচ তখন উমর (রা.)-এর মতো সাহাবিরাও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে ইতস্তত করছিলেন।
ইসলামকে তিনিই সব চেয়ে ভালো বুঝেছিলেন, এ ঘটনা তারই প্রমাণ। মৃত্যুর আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন, দুনিয়া অথবা আল্লাহর কাছে যা আছে, সে আল্লাহর কাছে যা আছে তাকেই বেছে নিয়েছে। এ কথা যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পূর্বাভাব, তা একমাত্র আবু বকরই বুঝতে পেরে কেঁদেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছিলেন, আমি যদি কাউকে আল্লাহ ছাড়া বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম, তাহলে সে হতো আবু বকর; কিন্তু এ ছাড়া ইসলামে রয়েছে ভ্রাতৃত্ব ও প্রীতির বন্ধন। আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদে প্রবেশের আর সকল দরজা বন্ধ করে দাও।’
তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার খুতবা ছিল সারগর্ভ, ভাষাশৈলী চমৎকার। মানুষকে কিভাবে তার বুদ্ধির স্তর অনুযায়ী আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে সুন্দরভাবে, তার কাছে সে শিক্ষা আমরা পেতে পারি। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় সব সাহাবা মনক্ষুণ্ণ ছিলেন আবু বকর ছাড়া। আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরা থেকে যেটা এসেছে। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতহে জানিয়েছিলেন যে, তা ছিল এক সুস্পষ্ট বিজয় এবং সকলেই পরে তা বুঝতে পেরেছেন।
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরিতে প্রথম ইসলামি হজ পালনের সময় তাকে হজের আমির হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নবীরা যেখানে মারা যান, সেখানেই তাদের কবর দেওয়া হয় একথা আবু বকরই জানিয়েছেন এবং এভাবে কোথায় নবী (সা.)-এর কবর হবে সে বিতর্কের অবসান ঘটেছে। আর নবীরা যা রেখে যান মৃত্যুর পর, তা সদকা, তা মীরাস হিসাবে বণ্টিত হয় না, একথাও আবু বকরের কাছ থেকেই সবাই জেনেছে, যখন ফাতেমা (রা.) পিতার মৃত্যুর পর মিরাস দাবি করেছিলেন। কোরআনে সরাসরি আবু বকর (রা.)-এর নাম উল্লেখ করা না হলেও, সুরা আত-তাওবার ৪০ নম্বর আয়াতে তার এবং নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর গুহা থেকে হিজরতের ঘটনাটি পরোক্ষভাবে তার প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো, তবুও আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সানিয়া ইসনাইন (দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থাৎ আবু বকর); যখন তারা দুজন গুহায় ছিল...।’ হিজরতের ঘটনায় আবু বাকর (রা.) বলেন, যখন আমরা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন আমি নবী (সা.)-কে বলেছিলাম, ‘ওই মুশরিকরা (যারা আমাদের পেছন ধরেছে তারা) যদি নিজেদের পায়ের নিচে তাকায়, তাহলে অবশ্যই আমাদের দেখে নেবে।’ নবী (সা.) বললেন, ‘হে আবু বাকর, তোমার সেই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কি ধারণা, যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ?’ অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আল্লাহর সাহায্য ও মদদ রয়েছে। (বোখারি)।