ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাষ্ট্র সংস্কারে ১২ দফা ঐকমত্য, শঙ্কা কাটেনি কর্তৃত্ববাদ ফেরার

রাষ্ট্র সংস্কারে ১২ দফা ঐকমত্য, শঙ্কা কাটেনি কর্তৃত্ববাদ ফেরার

জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলার আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল সাধারণ মানুষের মনে। রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে সেসব প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি এঁকেছিল শিক্ষার্থীরা। স্বৈরতন্ত্র প্রতিহত করে গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রত্যাশা ছিল সর্বত্র।

অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ধাপে সংবিধান, নির্বাচন ও বিচার বিভাগ নিয়ে গঠন করা হয় ছয়টি কমিশন। পরে যুক্ত হয় আরও পাঁচটি কমিশন— স্বাস্থ্য, পুলিশ, স্থানীয় সরকারসহ নানা খাতের সংস্কারের লক্ষ্যে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কয়েক মাসব্যাপী সংলাপ শেষে ১২টি মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো- কেউ সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে, সর্বমোট ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন।

তবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনও একমত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রশ্নে দলগুলো সম্মত হলেও অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির বিষয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও বিচারিক স্বাধীনতার বিষয়েও ঐকমত্য হয়নি। এমনকি স্থানীয় সরকার, পুলিশ বা স্বাস্থ্যখাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিয়েও আলোচনাই হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে এই ১২টি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়। বরং, কিছু মৌলিক সংস্কার এড়িয়ে গিয়ে সরকার জনআকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছে বলেই মনে করছেন অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল কর্তৃত্ববাদী ধারা যেন আর ফিরে না আসে—কিন্তু সেই জায়গাতেই তেমন অগ্রগতি নেই। তার মতে, পূর্বের ধারাবাহিকতাই যেন আবারও ফিরে এসেছে, ফলে ভবিষ্যতের সংস্কার নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ বিষয়ে এখনও ঐকমত্য হয়নি। এতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, সময়ক্ষেপণ করতে করতে পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক কথাবার্তায় আটকে পড়বে। তার মতে, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কারই সফল হতে পারে না এবং সরকারের উচিত এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া।

সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়ে গেছে। কেউ বলছেন, গণপরিষদের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে হবে, কেউ আবার মনে করছেন, পরবর্তী সংসদই যথেষ্ট। তবে দুই ক্ষেত্রেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে—সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কোনো দল ইচ্ছাকৃতভাবে সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা দিতে পারে।

ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি, তবুও সার্বিক পরিস্থিতিতে তারা কার্যকরভাবে দেশ চালাচ্ছে। তার মতে, ভবিষ্যতে চাইলে গণপরিষদ গঠন করা যেতে পারে, আবার সংসদীয় পথেও পরিবর্তন সম্ভব। তবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সবকিছু ভবিষ্যতের নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিলে তা আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।

ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, দলীয় ভিত্তিতে গঠিত গণপরিষদেও যদি একক দল দুই-তৃতীয়াংশ পেয়ে যায়, তাহলে সংস্কার আবারও থমকে যেতে পারে। তার মতে, ইচ্ছাকৃতভাবেই বিষয়টিকে জটিলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ৫ আগস্টকে ঘিরে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের আশা ছিল—তা পূরণ হয়নি। নেতারা এখনও স্বার্থের জালে বন্দি, ফলে ১৯৯০ সালের তিন দলীয় রূপরেখার মতো এবারও রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গেছে।

কর্তৃত্ববাদ ফেরার,১২ দফা ঐকমত্য,রাষ্ট্র সংস্কার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত