ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল

‘জামায়াতকে আর মাথায় উঠতে দেবো না, এনসিপিকে কোনও শক্তিই মনে করি না’

‘জামায়াতকে আর মাথায় উঠতে দেবো না, এনসিপিকে কোনও শক্তিই মনে করি না’

‘জামায়াতকে আর আমরা মাথায় উঠতে দেবো না। তারা যত বড় না শক্তি, আমরা অকারণে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি’—এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, জামায়াত ভোটে আসবে। পিআর–টিআর নয়, মানুষ যে পদ্ধতিতে ভোট বোঝেন, সেই প্রচলিত পদ্ধতিতেই হবে বাংলাদেশের ভোট। জামায়াতও দেখবেন অংশ নেবে। আর এনসিপি-কে আমরা কোনও শক্তি বলেই আর মনে করি না। এটা ঠিক এই ছাত্ররাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বারুদে আগুনটা দিয়েছিল। এখন আর তাদের কিছু নেই। ডাকলে লোকও আসে না।

ভারতের কোলকাতার বাংলা দৈনিক পত্রিকা ‘এই সময়’-এর সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সম্প্রতি ঢাকার গুলশানে সাক্ষাৎকারটি দেন মির্জা ফখরুল। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

আলোকিত বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য সাংক্ষাৎকারটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো—

এই সময়: আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন কি আদৌ হবে? জামায়াতে ইসলামি এবং এনসিপি যে ভাবে একটার পরে একটা নতুন দাবি তুলছে, এবং সেগুলো পূরণ না হলে নির্বাচন হতে দেবে না বলছে, অনেকেই সংশয়ে। হলেও দেশজুড়ে প্রবল অশান্তি ও রক্তপাত হবে?

মির্জা ফখরুল: আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতেই ভোট হবে। সংশয়ের কোনও জায়গা নেই। কোনও অশান্তি হবে না। মানুষ ভোটাধিকার ফেরত চাইছেন, নির্বাচন চাইছেন। উৎসবের মতো ভোট হবে ফেব্রুয়ারিতে।

এই সময়: জামায়াত যে বলছে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি ছাড়া ভোট হবে না, এনসিপি প্রচলিত সংবিধান বাতিল করে আগে গণপরিষদের নির্বাচন চাইছে। না হলে ভোট হতে দেবে না বলছে...

মির্জা ফখরুল: জামায়াত ভোটে আসবে। পিআর–টিআর নয়, মানুষ যে পদ্ধতিতে ভোট বোঝেন, সেই প্রচলিত পদ্ধতিতেই হবে বাংলাদেশের ভোট। জামায়াতও দেখবেন অংশ নেবে। আর এনসিপি-কে আমরা কোনও শক্তি বলেই আর মনে করি না। এটা ঠিক এই ছাত্ররাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বারুদে আগুনটা দিয়েছিল। এখন আর তাদের কিছু নেই। ডাকলে লোকও আসে না।

এই সময়: শোনা যায়, এনসিপি নাকি আপনাদের কাছে আসন চেয়েছিল?

মির্জা ফখরুল: না। এনসিপি কখনও চায়নি। তবে জামায়াত চেয়েছে। এনসিপি-র এখন একমাত্র লক্ষ্য, বিএনপিকে সরকার গঠন করতে না-দেওয়া।

এই সময়: জামায়াত ৫০টা আসন চেয়েছে?

মির্জা ফখরুল: ৩০টা চেয়েছে। আমরা উৎসাহ দেখাইনি। অনেক কম একটা সংখ্যার কথা বলেছি, যা তাদের মনঃপূত হয়নি। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, জামায়াতকে আর আমরা মাথায় উঠতে দেবো না। তারা যত বড় না শক্তি, আমরা অকারণে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পিআর-টিআর সবই বিএনপির উপরে চাপ সৃষ্টির কৌশল। জামায়াত কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করছে। আসলে দেশের প্রবল ভাবেই মানুষ নির্বাচন চাইছেন। সেনাবাহিনী চাইছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও চাইছেন।

এই সময়: নির্বাচনের বিষয়ে ইউনূসের উপরে আপনি আস্থা রাখছেন? কিছু দিন আগেও তো তাঁর বিরুদ্ধে এনসিপি-র প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন আপনারা। তিনি নির্বাচন করাতে চান না, এমন কথাও বলা হয়েছে।

মির্জা ফখরুল: পরিস্থিতি বদলেছে। দলের পক্ষে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি। দেখছি, এখন তিনি সর্বোচ্চ সিরিয়াস। আন্তরিক ভাবেই চান ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হোক। অগস্টের ৫ তারিখে ইউনূস নির্বাচনের দিন ঘোষণা করলেন। তার আগের দিন রাতে ইউনূস সাহেবের বাসভবনে তাঁর ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ়–জামানের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়।

সেনাপ্রধান বলেন, পুলিশ কম বলে এক বছর ধরে সেনাদের রাস্তায় ডিউটি করতে হচ্ছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। তিনি ডিসেম্বরে ভোটের কথা বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারিতে আপত্তি নেই। সব রকম সহযোগিতা করবেন। তিনি চান, নির্বাচন করিয়ে বাহিনী এ বার ব্যারাকে ফিরুক। ইউনূসও বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে অব্যাহতি চান তিনি। বলেছেন, আর চাপ নিতে পারছেন না। আমরাও আশ্বাস দিয়েছি, সরকার গঠনের পরেও সংস্কার চলবে। স্বৈরাচারীদের বিচার প্রক্রিয়াও চলবে। তিনটি আলাদা বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও ম্যান্ডেট নেই, তাদের সংস্কারের গুরুত্বই বা কী! নতুন কথা তারা বলেনি। বিএনপির ৩১ দফায় সবই আছে।

এই সময়: সম্প্রতি যে দিন জাতীয় পার্টির অফিস ভাঙচুর হলো, তার পরের দিন বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি নেতৃত্বকে বাসভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ইউনূস। কেন? তিনি কি কোনও বিশেষ বার্তা দিলেন আপনাদের?

মির্জা ফখরুল: (খানিক চুপ করে থাকার পরে) ঠিকই বলেছেন। সে দিন ইউনূস আমাদের একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। সে বার্তা সংক্ষিপ্ত, এক লাইনের। এক ধরনের ফাইনাল বেল বলতে পারেন। ইউনূস সে দিন আমাদের জানিয়ে দেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোটের বাস ধরতে না পারলে তিনি মার্চ থেকে আর থাকবেন না। এমন পরিস্থিতি যেন না হয়, যাতে ভোটটাই করা গেল না।

এই সময়: আওয়ামী লীগ কি আগামী ভোটে অংশ নিতে পারবে? জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) বা ওয়ার্কার্স পার্টির মতো তাদের শরিকেরা?

মির্জা ফখরুল: আমরা বলেছি আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকেরা সবাই, এমনকি জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিক। একটা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হোক। এ জন্য অনেকে আমাকে ভারতের এজেন্ট, আওয়ামির দালাল বলে গালাগাল দিচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনার অপকর্ম আমরাও কেন করব? হাসিনা ১৫ বছর প্রতিপক্ষকে ভোটে দাঁড়াতেই দেননি, তার শাস্তি পেয়েছেন। একই কাজ করলে আমরাও তো প্রতিফল পাব। তবে মানুষ এত রক্ত দেখেছেন, এত প্রাণহানি— তাঁদের মধ্যে আওয়ামী-বিরোধিতা রয়েছে।

এই সময়: ইউনূস বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রভাব ছাড়া নির্বাচন ও সরকার গঠন হবে। সত্যিই কি বাংলাদেশে ভারতের কোনও প্রভাব আর অবশিষ্ট নেই?

মির্জা ফখরুল​​​​​​​: ভারত মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী। সেই সময়ে এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। ভৌগোলিক ভাবেও বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত, এক দিকে সাগর। সুতরাং ভারতের প্রভাব বাংলাদেশে থাকবেই। সমস্যা হলো, বাংলাদেশ বলতে শুধু আওয়ামী লীগকে বুঝেছে ভারতের শাসকেরা।

আওয়ামী লীগের ভাষ্য মেনে বিএনপি আর জামায়াতকে একই বন্ধনীতে ফেলেছে। জামায়াত আর বিএনপির রাজনীতি তো এক নয়। আমরা অসাম্প্রদায়িক, মধ্যপন্থী একটি গণতান্ত্রিক দল। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সংবিধান রক্ষায় আজও আমরা স্বাধীনতা-বিরোধীদের সঙ্গে লড়াই করছি। বামেরা আমাদের সঙ্গে রয়েছে।

এই সময়: পঁচিশ বছর ধরে জামায়াত আপনাদের শরিক। দুটো নাম তাই এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

মির্জা ফখরুল​​​​​​​: ভুল। আওয়ামী লীগ এই অপপ্রচারটা ভারতকে বিশ্বাস করিয়েছে। তারা শুধুই নির্বাচনী শরিক। তারা ধর্মীয় রাজনীতি করে, আমরা করি না। আসলে আওয়ামীর চশমা দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে দেখেই ভুলটা করেছে।

বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগই রাখেনি। আজ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাহাড় তীব্র ভারত-বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে বিএনপির পক্ষে আমি আশ্বাস দিচ্ছি, জামায়াতকে আর সুবিধা নিতে দেবো না। আমরা চাই, ভারত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক। আমরা কলকাতা যাব, কলেজ স্ট্রিট থেকে কত বই কিনেছি। আবার সেই সুযোগ পাব। সিনেমা, থিয়েটার দেখব। মানুষে মানুষে অবাধ যোগাযোগ হবে। ভিসা প্রক্রিয়া সাবলীল হবে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশ স্বাগত। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক।

জামায়াত,এনসিপি,মির্জা ফখরুল,বিএনপি,এই সময়,সাক্ষাৎকার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত