ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ছোটগল্প

গোপন চক্ষু

টি এম কায়সার
গোপন চক্ষু

মেয়েটা আজ পুরো একদিন এক রাত্রি শেষে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছে, এই দৃশ্যে আছে কিছু অগ্ন্যাশয়ভেদী বেদনা ও বিলাপ-বোধ করি তা দেখা যাচ্ছে এবং পাঠও করা যাচ্ছে ঠিকঠাক!

কিন্তু বাড়ি? বাড়ি মানে কী বসার ঘরে রাখা একখানা বিশাল তানপুরা- অনেক সুর, একটু একটু শৌর্য ও গোপন অথচ স্মৃতি হাতড়ালে শিরা উপশিরায় ব্যাখ্যাতীত আনন্দের স্রোত বয়ে যায়, এমন সব সঙ্গম? অথবা পেছনে গার্ডেন মতো জায়গাটায় অজস্র ড্যাফোডিল ফুলের চারা- যারা একটু একটু বাড়ে আর অনেক বেশি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়? আর তাতে হৃদয়, হায়রে হৃদয়, কী শোচনীয়ভাবেই না পোড়ে; কী দুঃসহ এই ক্ষয় ও ক্ষরণ!

গণেশ নামে যে দুষ্টু অথচ নিষ্পাপ কুকুরছানাকে ইনজেকশন দিয়ে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো, মেঝেতে এবং বিছানায় তার কচি কচি সব লোমের মাঝেই কী বাড়ি লুকিয়ে থাকে?

নাকি রান্না ঘরে গণেশের লেজ নাড়তে নাড়তে মা- মানে এই একা মেয়েটার দিকে এক টুকরো চিকেনের হাড়ের জন্য পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকার জ্বলজ্বল সব স্মৃতিই আসলে বাড়ি? বাড়ি- নাকি আসলে এইসব দগদগে স্মৃতির আঁতুড়ঘর?

কিন্তু ঐ ড্যাফোডিল ফুল- যখন সব ঝরে পড়ে, এই একা মেয়েটা কী দরজায় মুখ লুকিয়ে খুব কাঁদে গো?

তবে কান্না কী আর আদৌ লুকিয়ে রাখা যায়? সহোদর ভাই গণেশ মারা যাবার পর নিষ্ঠুরভাবে একা হয়ে যাওয়া কুকুরছানা রণেশ হয়তো মায়ের এই কান্নার দৃশ্য দেখে লেজ নাড়াতে নাড়াতে কিছু একটা বিড়বিড় করে সান্ত¡না দেয়!

রণেশ, দুষ্টু কুকুরছানা হয়ত মানুষের থেকেও কত গভীর মনুষ্যত্ব নিয়ে রোমন্থন করে মৃত-সহোদরের স্মৃতি! শোক-মুহ্যমান থাকে দিনের পর দিন, এত লোভনীয় চিকেনের হাড় মুখের কাছে নিয়ে সাধলেও রা টুকু করে না পর্যন্ত; কী আশ্চর্য এই ভ্রাতৃপ্রেম!

সহোদরের মৃত্যুর পর কী যে অবলা, কী যে একা হয়ে গেল রণেশ!

বাড়ি ফিরে একা মেয়েটা হয়ত দেখবে নিচে করিডোরের পাশে সহোদরের শয্যায় শুয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে রণেশ, গণেশের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ হতে চলেছে, কিন্তু তাতে কী!

দরোজায় কারো আঙুলের ঠোকা পড়তেই দুই ভাই মিলে বাড়িঘর একাকার করে তোলার স্মৃতি মনে এলো; কিন্তু তাতে ভেতরটা এত হু হু করে ওঠে কেন কে জানে! এখন দরোজায় ডাকাত এসে হানা দিলেও রণেশ নিজের আসনে শুয়ে এক আধটু কুইকুই করে শুধুমাত্র দুহাত দূরে থেকেও তা শোনা যায় না, এমনই নিঃশব্দে!

বাড়িতে অতিথি এলে রণেশ ধীরে হেঁটে তাদের গা ঘেঁষে চুপটি মেরে বসে থাকে, “আমার খেলার সঙ্গী হবে গো তুমি? দুষ্টু ভাইটাতো আমায় ছেড়ে চলে গেছে” হয়ত বলে মনে মনে!

মাত্র দু-তিন সপ্তাহেই এমন কাঙাল হয়ে উঠলো রণেশ? সবকিছু এত আমূল বদলে যাচ্ছে- এটা ভেবে ভেবে একা মেয়ের ভেতরটা আবার খুব মোচড় দিয়ে উঠল হয়ত! একা মেয়েটার বাবা বলত, দুঃখ পেলে ভেঙে পড়িস না বোকা! দুঃখ যারা নিতে জানে ভগবান ভালোবেসে তাদের অনেক দুঃখ দেয়, তাতে খুলে যায় তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, গোপন চক্ষু!

ঘোড়ার ডিমের চক্ষু- বিড়বিড় করে আওড়ায় একা মেয়েটা! বাবাও যে একদিন কিছু না বলেই দূর নক্ষত্রের ভুবনে হারিয়ে গেল- এখন এই সব নতুন নতুন দুঃখ বেদনায় গোপন-চক্ষুর ভাষণটুকুইবা আর কে দেবে!

গণেশ ভেটের কাছে যাবার ঠিক আগেও বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মা- মানে একা মেয়েটার দিকে কী অসহায় অথচ কী অন্তর্ভেদী চোখে তাকিয়েছিল! গণেশ কী সেদিন বুঝে গিয়েছিল এই বাড়িতে সে আর কোনোদিনই সশরীরে ফিরবে না?

মৃত্যু হবে- এটা নিশ্চিত জেনে যাবার পর একা মেয়েটা যখন শেষবারের মতো ভেট-সার্জারিতে দেখতে গিয়েছে, গণেশ অক্সিজেন মাস্ক খুলে রীতিমতো লাফিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে, যেন, “মা এখানে অনেক তো হয়েছে, এবার বাড়ি চলো!”

হয়ত ভেবেছে মা যখন চলেই এসেছে এবার নিশ্চয় একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেই! মা তো এমনই- সকল রোগব্যাধি তো নস্যি মায়ের দোর্দন্ড ক্ষমতার কাছে! একা মেয়েটা গণেশকে কোলে নিয়ে তার দুই গাল চেপে ধরে বসে আছে আর ভেট নিঃশব্দে ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিয়েছে গণেশের ডান উরুতে...

গণেশ বলছে মা আমাকে শক্ত করে ধরো, বাড়ি যাবো এবার..

মা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলছে, আবার আমাদের নতুন একটা বাড়ি হবে বাপ! তুই আমি আর রণেশৃওখানে আর কেউ নেই!

গণেশ বলছে, তোমায় আর দেখতে পাচ্ছি না কেন মা? মা, ও মা! মাগো..

একা মেয়েটা বাড়ি ফিরে রণেশের মুখোমুখি হতে কী খুব ভয় পেয়েছিল সেদিন? বা এখন ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে রণেশকে দেখা মাত্রই কী খুব ভয় পাবে? এই যে নির্বাক রণেশ বার বার জিজ্ঞেস করছে, আমাকেও কী গণেশের মতো একদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখবে মা? শরীরের সব রক্ত দিয়েও এই প্রশ্নের উত্তর কী কোথাও লিখে রাখা যায়?

ট্রেন ছাড়ল।

এই দৃশ্যে যে ছেলেটা বারবার বিদায় দিতে স্টেশনগার্ডকে বলে মেটালগেট পার হয়ে ট্রেনের প্লাটফর্ম পর্যন্ত এগিয়ে আসলো, বারবার তাকেই কেন এভাবে বিদায় দিতে আসতে হয়- এটুকু ভেবে ফেরার পথে এই যে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়ল ছেলেটা, তাতে কী কোনো পথচারী অন্তত এক মিনিটের জন্যও, থেমে তার দিকে খুব কৌতূহলভরে তাকিয়েছিল?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত