ঢাকা রোববার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গল্প

একটি সত্যি ভূতের গল্প

হোমায়রা মোর্শেদা আখতার
একটি সত্যি ভূতের গল্প

ইয়াছিন সাহেবের ছোট মেয়ে পিয়া। পুতুলের মতো মেয়েটি যেন বাতাসের আগে আগে দৌড়ে বেড়ায়। বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ঘাঘট নদীর ঢেউ আর নদীর ওপারের দূরের গ্রাম। কত কিছু প্রশ্ন করে যে সে! আর ভূতের গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। বাবার কাছে, মায়ের কাছে, দাদিমার কাছে তার একটাই আবদার, ভূতের গল্প শুনবে। পিয়ার বাবা-মা দু’জনই পেশায় শিক্ষক। পিয়ার বাবা ভূতের গল্প বলতে ভালোবাসেন; কিন্তু পিয়ার দাদির কাছে আছে ভূতের গল্পের টোপলা। সেই টোপলা থেকে যখন গল্প বের হতে থাকে, তখন পিয়া তন্ময় হয়ে সেই গল্প শোনে।

পিয়ার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তাই শীতের ছুটিতে দাদাবাড়ি গেছে। ওর ফুফাতো বোন লিপি, সুমি ও সুমনাও গেছে। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ছিবুড়ি, পাঁচগুটি খেলে খুব ভালো সময় কাটছে। আর সন্ধ্যা হলেই ওরা গুটিশুটি মেরে দাদিমার সঙ্গে একটা জিনিস দেখতে যায়। আর তাহলো পুকুরপাড়ের ন্যাটায় মাছ পড়ল কি-না। পুকুরপাড় মানেই ভূতের আড্ডাখানা। পুকুর পাড়ের পশ্চিম পাশে একটা বড় মাদারের গাছ আছে। সেটাই নাকি ভূতদের আস্তানা। তবুও চোখ বন্ধ করে হারিকেন নিয়ে ওদের মাছ দেখতে যাওয়া চাই।

ওই মাদার গাছটায় নাকি কত রকম ভূতপেত্নি থাকে। তার ইয়ত্তা নেই। মেছোভূত, পিঠাভূত আরও কত ভূত। পুকুর পাড়ে রানু ফুফুদের যে উঁচু ভিটা আছে, সেখানে বেশ কয়েকটা পুরোনো গাছ আছে। সেখানে নাকি দিনের বেলাও ভূত-পেত্নি দেখা যায়। পিয়ার দাদাবাড়ির চারপাশ ঘিরেই এত ভূতদের আস্তানা যে, সন্ধ্যা হতেই কেমন যেন গ্রামটা আধিভৌতিক হয়ে যায়।

আজ পিয়ার দাদি পিঠা ভাজবে। তারই প্রস্তুতি চলছে। ঢেঁকিতে আটা কোটা হচ্ছে। গাছ থেকে নারকেল পাড়া হয়েছে। দাদা মিয়া দাড়িয়াপুরের হাঁট থেকে নতুন আখের নতুন গুড় এনেছে। পিঠা বানানো মানে যেন এক মহা উৎসব। এ গ্রামে সন্ধ্যার পর কেউ মাছ ভাজে না। এখান নাকি মেছো ভূতের খুব উৎপাত। কেউ মাছ ভাজতে গেলেই নাকি সুযোগ বুঝে মেছোভূতের বউ গিয়ে ভাজা মাছ চুরি করে আনবেই। তাই কেউ রাতের বেলা মাছ ভাজে না।

পিয়ার দাদি আবার খুব সাহসী। সবাই বলে তার সঙ্গে নাকি ভূত-পেত্নিদের যোগাযোগ আছে। পিয়ার দাদির ক্ষতি করে না তারা। পিয়ার দাদি অবশ্য রাতের বেলা ওদের নাম মুখে আনেন না। ছদ্মনামে ডাকেন। দাদিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে খালি মুচকি মুচকি হাসেন।

পিয়ার দাদি যেদিন পিঠা ভাজেন অনেক পিঠা ভাজেন। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবার জন্য পিঠা ভাজেন। আট-দশ কেজি চালের পিঠা ভাজেন। তাই সব কাজ শেষ করে সবাইকে রতের খাবার খাইয়ে দাইয়ে তারপর পিঠা ভাজতে বসেন অনেক রাতে। এরপর পিঠা ভাজতে ভাজতে সকাল হয়ে যায়। রান্নাঘরের চালে টপটপ করে শিশির পড়তে থাকে আর তার তালে তালে দাদিমা পিঠা ভাজেন। সবাই বলে পিয়ার দাদি নাকি ভূত-পেত্নিদেরও পিঠা খেতে দেন। তাই তাদের জন্য পিঠা ভাজেন। কেউ কেউ বলে পিয়ার দাদিমার শাশুড়ি নাকি এক পেত্নি সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। তাই পেত্নি অভিশাপ দিয়েছিল। সেই অভিশাপ কাটানোর জন্যই নাকি পিয়ার দাদি ভূত-পেত্নিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে।

পিয়ার দাদি পিঠা ভেজে চলেছেন। আর তাকে সাহায্য করছে শেফালীর মা। পাশে চার বোন পিঠা ভাজা দেখছে। পিঠা কতটা ফুলল, তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। পিঠা না ফুললে দাদিমা বলে এই তোর গাল ফুলিয়ে বস। না হলে তো পিঠা ফুলবে না। অমনি চার বোন গাল ফুলিয়ে রাখে। ওরা দাদিমাকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা- কী করেছিল বড় মা পেত্নিদের সঙ্গে। একটু বল না। দাদিমা বলেন, এই এখন এসব বলিস না। ওরা বলে, বলো না সেই কাহিনিটা। অবশেষে দাদিমা বলে- এরকম দিনে বড়মা পিঠা ভাজছিলেন। হঠাৎ দেখেন একটা ছোট্ট বউ এসে নাকিসুরে বলছে- পিঠা দে, পিঠা দে, পিঠা দে। অমনি বড়মা পিঠা ভাজার গরম তেল সেই বউয়ের হাতে ঢেলে দিয়েছিল। তখন সেই বউ গরম তেলের ছ্যাঁকা খেয়ে দৌড়াতে থাকে আর কাঁদতে কাঁদতে অভিশাপ দেয়। আসলে ওটা বউ ছিল না, ছিল মাদার গাছের ভ- পেত্নি। বউয়ের সাজে পিঠা চাইতে এসেছিল। দাদিমা বলেন, তার কাছে যারা অসেন তারা গভীর রাতে পিঠা নিতে আসেন। তাদের জন্য দাদি নতুন মাটির হাড়িতে পিঠা রাখেন। এইসব বলতে বলতে হঠাৎ পিয়া দেয় চিৎকার। সুমি ভয়ে গোঁ গোঁ করতে থাকে। সুমনা অজ্ঞান হয়ে যায়।

লিপি ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই দেখে একটা ছোট্ট কালো বউ এসে লোমশ হাত পাতল রান্নাঘরের জানালায়। আর কিছু ওদের মনে নেই। পরদিন দেখে মাদারগাছের পাশে দাদিমার নতুন মাটির হাড়িটা পড়ে আছে। সেই থেকে ওরা আর পুকুরঘাটে যায় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত