
ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যা গাজায় তাদের যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনের এ শহরটি গাজা উপত্যকার উত্তরে এবং সেখানে লাখ লাখ মানুষ বাস করে। ইসরায়েলের ভেতরেই এ পরিকল্পনা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। সামরিক কর্মকর্তা, জিম্মিদের পরিবার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও সমালোচনা আসছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল পুরো গাজা উপত্যকা দখলের পরিকল্পনা করছে। শেষ পর্যন্ত এটি আরব শক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনও ইসরায়েল প্রকাশ করেনি। পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হওয়ার আগে দেশটির সামরিক নেতৃত্ব ও বিরোধী দলও সতর্কতা উচ্চারণ করে বলছিল, গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষোভের মধ্যে এ পদক্ষেপ ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলবে।
পরিকল্পনা সম্পর্কে যা জানা যায় : এ পরিকল্পনা বা যুদ্ধ অবসানের পাঁচ নীতিতে আছে- ১. হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ, ২. জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা, ৩. গাজা উপত্যকা বেসামরিকীকরণ, ৪. গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ, ৫. হামাস বা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে বাদ দিয়ে বিকল্প বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা। আইডিএফ বলছে, যুদ্ধ এলাকার বাইরে বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে সামরিক বাহিনী প্রস্তুত হবে। তবে এ মানবিক সহায়তাও নতুন কিছু কি না কিংবা এগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা অন্য কোনো ব্যবস্থায় দেওয়া হবে কিনা, এর কিছুই স্পষ্ট নয়।
শুধু গাজা নেওয়ার কারণ : মন্ত্রিসভা বৈঠকের আগে নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি চান- গাজার পুরোটাই ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণে নিক। তবে নতুন যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে শুধু গাজা শহরকেই রাখা হয়েছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা এখন গাজার ৭৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের হিসেবে, গাজার ৮৬ শতাংশ ভূখণ্ডই হয়তো সামরিক জোন কিংবা লোকজনকে সরে যাওয়ার আদেশের আওতায়। শহরের নিয়ন্ত্রণটাই হয়তো গাজা উপত্যকা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রথম ধাপ হবে। আবার এ ধারণাও আছে, গাজা উপত্যকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি আসলে হামাসের ওপর আলোচনায় ছাড় দেওয়ার জন্য চাপ তৈরির কৌশল। নেতানিয়াহু গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইসরায়েল এটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় না। তাদের লক্ষ্য হলো, আরব শক্তিগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া।
নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সম্ভাব্য ক্ষণ : নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কার্যক্রম কখন শুরু হবে, তা ইসরায়েল এখনও বলেনি। তবে দেশটির সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তাতে বলা হচ্ছে, শহরের অধিবাসীদের আগে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হবে বলে সামরিক বাহিনী এখনই গাজা শহরে যাবে না। দেশটি বলছে, হামাসকে পরাজিত করতে বা জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে এর বিকল্প কোনো পরিকল্পনা কাজে আসবে না বলেই তাদের বিশ্বাস। যদিও বিকল্প পরিকল্পনা বলতে কি বোঝানো হয়েছে বা কারা এটি দিয়েছে, সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটির সেনাপ্রধানের কাছ থেকে আরেকটি সীমিত প্রস্তাব এসেছে। এদিকে নেতানিয়াহু আরবশক্তির কথা বললেও সেটি কারা, তা ইচ্ছাকৃত অস্পষ্ট রেখেছেন। তিনি হয়তো জর্ডান বা মিসরের কথা বলতে পারেন। তারা এরই মধ্যে বলেছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করতে চায়। তবে ইসরায়েলি দখলে সমর্থন যোগাতে তারা গাজায় যাবে না বলে জানিয়েছে। গাজার নিয়ন্ত্রণ-উত্তর সরকার নিয়েও কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়নি। ইসরায়েলের এ পরিকল্পনা সম্পর্কে হামাসের দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে বিশ্ব-প্রতিক্রিয়া : বিশ্ব নেতা ও জিম্মিদের পরিবারের দিক থেকে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে। ইসরায়েলের সামরিক নেতৃত্বও বলছে, গাজায় তাদের কাজ শেষ। কারণ, হামাস এখন আর সুসংগঠিত সামরিক শক্তি হিসেবে কোনো হুমকি নয় বলেই তারা মনে করে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার ইসরায়েলের এ চিন্তাকে ভুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি শুধু আরও রক্তপাত বয়ে আনবে। গাজায় সামরিক অভিযানের সম্প্রসারণকে যুদ্ধাপরাধের ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্যালেস্টানিয়ান ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ প্রেসিডেন্ট মুস্তফা বারঘৌতি।
ওদিকে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের নিজের ভূমি থেকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করাই হলো ইসরায়েলের লক্ষ্য। ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিনা ভালটোনেন দ্রুত যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। অস্ট্রেলিয়াও সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি উং বলেছেন, গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কেবল গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যয়কর করে তুলবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেছেন, গাজা যুদ্ধের এখনই অবসান হওয়া উচিত। তার মতে, আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি কেবল আরও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া, আরও হত্যা, আরও দুর্ভোগ ও ধ্বংস আর নিষ্ঠুর অপরাধ বাড়াবে। জিম্মিদের পরিবারের ফোরাম বলছে, এ সিদ্ধান্ত জিম্মি ও আমাদের সৈন্যদের বড় বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে কিছু সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, আমেরিকা নেতানিয়াহুকে গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে সবুজ সংকেত দিয়েছে। তবে সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে ফোনে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়ের খবর দিয়েছে। ট্রাম্প অবশ্য একে ‘ফেইক নিউজ’ বলেছেন।