ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মহানবীর (সা.) জন্মদিন পালনের প্রাসঙ্গিকতা

ইলিয়াস মশহুদ
মহানবীর (সা.) জন্মদিন পালনের প্রাসঙ্গিকতা

আরবি বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাসের নাম রবিউল আউয়াল। ইসলামের ইতিহাসে এ মাসের রয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা। কারণ, মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ (সা.) এ মাসেই দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন। তার জন্মের মাধ্যমে দুনিয়ার অন্ধকার দূর হয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ে; মানবজাতি মুক্তির সঠিক দিশা পায়। আবার ভাগ্যের লিখনেই এ মাসেই তিনি ইন্তেকাল করেন। জন্ম ও মৃত্যুর এ দুই মহান ঘটনার কারণে রবিউল আউয়াল মুসলমানদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। রাসুল (সা.)-এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবনের সব ঘটনা জানা মুসলমানদের করণীয় এবং তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার নিদর্শন। বিশেষত, নবুওয়তের পরের কথা এবং কাজ জানা তো দীনের অন্তর্ভুক্ত। সাহাবিগণ যেহেতু রাসুল (সা.)-কে অধিক ভালোবাসতেন, তাই রাসুল (সা.)-এর আলোচনাও তারা বেশি করতেন। এজন্য হাদিসের কিতাবাদিতে রাসুল (সা.)-এর দৈহিক কাঠামো, গুণাবলি ও খুঁটিনাটি অনেক কিছু বর্ণিত হয়েছে। কখনও তারা বয়ানের মজলিসে, কখনও পরস্পর আলোচনায়, কখনও দরস-তাদরিসে রাসুল (সা.)-এর আলোচনা করেছেন; কিন্তু রাসুল (সা.)-এর জন্মগ্রহণ এবং সে সংক্রান্ত ঘটনার তেমন উল্লেখ তাতে পাওয়া যায়নি। অন্যান্য সাধারণ ঘটনার মতো জন্মের ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। বলা যায়, খাইরুল কুরুনে বয়ানের পদ্ধতি এমনই ছিল।

ঈদে মিলাদুন্নবি : কোনো আমল শরিয়তসম্মত হতে হলে তা রাসুল (সা.)-এর যুগে অথবা খাইরুল কুরুনে স্পষ্টভাবে অথবা ইঙ্গিতে প্রমাণিত হতে হবে। সুতরাং রাসুল (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে যে ঈদের আয়োজন করা হয়, সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি ও মুজতাহিদ ইমামগণের যুগে এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। এ বিষয়ে সকলে একমত, রাসুল (সা.)-এর জন্মের আলোচনা করা মানদুব ও মুস্তাহাব। তবে কথা হচ্ছে মিলাদ নিয়ে। এ কথা স্পষ্ট, রাসুল (সা.)-এর জন্মবৃত্তান্ত এবং প্রচলিত মিলাদ ভিন্ন। কোনো শর্ত ও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া তা করা মুস্তাহাব। কেননা, খাইরুল কুরুনে বিষয়টি প্রমাণিত; আর মিলাদ মাহফিল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, সময় নির্ধারণ করে মানুষ ডেকে গুরুত্বের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর জন্মের আলোচনা করা, যার অস্তিত্ব খাইরুল কুরুনে ছিল না। প্রথমে জানা দরকার, রাসুল (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে বিশেষ পদ্ধতিতে জন্মবার্ষিকী পালন কবে শুরু হয়েছে? তারিখে ইবনে খাল্লিকানে বর্ণিত, প্রথমত ৬০৪ হিজরিতে মসুল শহরের বাদশা মুজাফফর উদ্দিন (মৃত্যু : ৬৩০ হিজরি)-এর নির্দেশে বিদআত সৃষ্টি হয়েছিল। যারা রাসুল (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে মিলাদ করেন। তারাও এ কথা মানেন, বাদশা মুজাফফর উদ্দিনের আগে কেউ রাসুল (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে মিলাদের আয়োজন করেনি।

মুজাফফর উদ্দিন যে মিলাদের আবিষ্কারক, এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘বাদশা মুজাফফর রবিউল আউয়ালে রাসুল (সা.)-এর মিলাদ পালন করতেন। এ উপলক্ষে মাহফিলের ব্যবস্থা করতেন।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১৩/১২৭)। মোটকথা, ১২ রবিউল আউয়ালে সর্বপ্রথম যার নির্দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী শুরু হয়েছিল, সে বাদশার অবস্থা সুবিধাজনক নয়। তিনি ছিলেন অপচয়কারী। যদিও ইতিহাসে তার কিছু ভালো গুণের কথাও উল্লেখ রয়েছে।

রাসুল (সা.) জন্ম উপলক্ষে কী করতেন : রাসুল (সা.) কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের জন্য আদর্শ। এখানে লক্ষণীয়, রাসুল (সা.) নিজে তার জন্মদিন উপলক্ষে কী করতেন? আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) সোমবারে রোজা রাখতেন। এ প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘সোমবারে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এ ছাড়া সোমবারে আমার ওপর প্রথম ওহি অবতীর্ণ হয়েছে।’ (মুসলিম : ১১৬২)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, রাসুল (সা.) প্রত্যেক সোমবারে রোজা রাখতেন। সোমবারে রাজা রাখার একাধিক কারণও ছিল। এর মধ্যে দুটি কারণ এ হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হলো, সোমবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, সেদিনই তার ওপর প্রথম ওহি নাজিল হয়। এ ছাড়া সোমবারে রোজা রাখার আরও দুটি কারণ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। একটি হলো, উসামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি বললাম, আল্লাহর রাসুল, আপনি কখনও ধারাবাহিক রোজা রাখেন, মনে হয় আর ভাঙবেন না। আবার কখনও ধারাবাহিকভাবে খেতে থাকেন, মনে হয় আর রোজা রাখবেন না। তবে দুদিন ছাড়া, সে দুদিন আপনি নিয়মিত রোজা রাখেন।’ তিনি বললেন, ‘কোন দুদিন?’ আমি বললাম, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার।’

তিনি বললেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আর আমি পছন্দ করি, রোজা অবস্থায় আমার আমল পেশ করা হোক।’ (মুসনাদে আহমদ : ২১৭৫৩)। দ্বিতীয়টি হলো, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমল পেশ করা হয়। আমি পছন্দ করি, আমার আমল রোজাবস্থায় আল্লাহর কাছে পেশ করা হোক।’ (শামায়েলে তিরমিজি : ২৮৮)। দুটি হাদিস থেকে সোমবারে রোজা রাখার আরেকটি কারণও জানা গেল। কেননা, সোমবারে আল্লাহর কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়। এ ছাড়া তিনি এটা পছন্দ করতেন, রোজা রাখাবস্থায় তার আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হোক। তা ছাড়া আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে আছে, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করেনি, তারা ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। তবে কারো অন্তরে অপর ভাই সম্পর্কে বিদ্বেষ থাকলে তাকে ক্ষমা করা হয় না।’ (মুসলিম : ২৫৬৫)।

মোটকথা, হাদিস থেকে সোমবারে রোজা রাখার মোট চারটি কারণ জানা গেল। তা হলো- নবীজি (সা.)-এর জন্মগ্রহণ, প্রথম ওহি নাজিল হওয়া, আল্লাহর কাছে আমল পেশ হওয়া এবং জান্নাতের দরজা খুলে যাওয়া। এ ছাড়া তার জন্ম উপলক্ষে সোমবার রোজা রাখা ছাড়া অন্য কোনো আমল প্রমাণিত নয়। সোমবার বছরে ৪৬ দিন থেকে ৫৪ দিন আসে, সে হিসেবে চাইলে কেউ বছরে প্রতি সোমবার রোজা রাখতে পারে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল নিজের জন্মদিন নির্ধারণ করে কোনো আমল তার থেকে প্রমাণিত নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, রাসুল (সা.) যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, রোজা রাখার জন্য সেদিনকে নির্ধারণ করেননি। যদি তারিখ নির্ধারণ করতেন, তাহলে রাসুল (সা.) প্রতি বছরের শুধু ১২ রবিউল আউয়াল রোজা রাখতেন। কারণ, সে তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন।

১২ রবিউল আউয়াল কি নিশ্চিত রাসুলের জন্মদিন : বর্তমানে প্রচার করা হয়, রাসুল (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন। আসলে কি নিশ্চিতভাবে এ কথা বলার সুযোগ আছে, তিনি ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন? প্রথমে মনে রাখতে হবে, রাসুল (সা.) কী বারে জন্মগ্রহণ করেছেন? এ ব্যাপারে সকলেই একমত, তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন; কিন্তু কোন মাস ও কোন তারিখে, সেটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই, রাসুল (সা.) সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। যারা বলেছেন, রাসুল (সা.) ১৭ রবিউল আউয়াল শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের দাবি ভুল।’ অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে, তিনি রবিউল আউয়ালে জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ২ রবিউল আউয়াল। কেউ বলেছেন, ৮ রবিউল আউয়াল। কেউ বলেন, ১০ রবিউল আউয়াল। কেউ বলেন, ১২ রবিউল আউয়াল। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। কারো মতে, সফর মাসে। (আস-সিরাতুন নবাবিয়্যাহ : ১/১৯৭-১৯৯)।

লেখক : সিরাত গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত