ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কাতার-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি কোন পথে

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
কাতার-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি কোন পথে

১৭ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাতার-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তির সংবাদ শুনে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি একজন খ্যাতিমান সাংবাদিকের একটি স্ট্যাটাস মনে পড়ে গেল। গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার অজুহাতে বিমান হামলার পর মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র বিশ্ব যখন কাতারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছিল, তখন ‘আরব জগতের নির্লজ্জ শাসকেরা’ শিরোনামে তিনি লিখেন, আরব শাসকদের মতো নির্লজ্জ, বেহায়া ও কাপুরুষ শাসক পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আছে বলে মনে হয় না। একসময় এরা ব্রিটিশের টোপে ‘বাদশা’, ‘আমির’, ‘সুলতান’ হওয়ার লোভে তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়েছে ব্রিটিশের চাকর হয়ে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের চাকর হয়ে কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই কাতারের আমির ট্রাম্পকে খুশি করার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যে ‘প্যালেস ইন দ্য স্কাই’ নামের বিমান উপঢৌকন দিয়েছে। বোয়িং থেকে ১৬০টি বিমান কেনাসহ ২৪৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। ১০ হাজার সৈন্যসহ আমেরিকান ঘাঁটি তো আগে থেকেই আছে। এত কিছুর পরও ইসরায়েলি বিমান জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, সৌদি আরবের আকাশসীমা ডিঙিয়ে কাতারে বিমান হামলা করে। কাতারের মনিব আমেরিকা জানে না, কীভাবে হামলা হলো! উল্লিখিত দেশগুলোও জানে না, কীভাবে ইসরায়েলি বিমান তাদের আকাশসীমা অতিক্রম করল। ওরা জানে, কীভাবে প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য দীঘলকেশী তরুণীদের কেশ দোলানো নৃত্য দেখাতে হবে। নপুংসক আরব শাসকদের মৌজ-মস্তি করতে দিয়ে আরব দেশগুলো পরিচালনার ঠিকাদারি ইসরায়েলকে দিয়ে দিলেই মধ্যপ্রাচ্য বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো চলবে। ক’দিন পর ইসরায়েল যদি মদিনা দখল করে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মদিনা তো একসময় ইহুদিদেরই অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল।

প্রবীণ এ সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ যে শতভাগ সত্য, তার প্রমাণ দিলেন খোদ আক্রান্ত দেশ কাতার। ইসরায়েল কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর কাতার আয়োজিত আরব লীগ এবং ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর সকল সদস্য রাষ্ট্রের দুদিনের জরুরি শীর্ষ সম্মেলনের একদিন পরই কাতার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় সামরিক চুক্তির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ আরব-ইসলামি দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনাকে নস্যাত করে দিল। এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স, আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আন-নাহিয়ান, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, ইরানের প্রধানমন্ত্রী মাসুদ পেজেশকিয়ান, পাক-প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ সিসিসহ প্রায় ৫৭ দেশের নেতা।

দুদিনের এ জরুরি শীর্ষ সম্মেলন থেকে গাজায় প্রায় দু’বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ ও চলমান মানবিক বিপর্যয় থামাতে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিরাপত্তা, ইসরায়েলের আগ্রাসন থামাতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি করে খোদ আক্রান্ত দেশ কাতার। প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিও ১৭ সেপ্টেম্বর দোহায় পৌঁছেন কাতার- যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন একটি উন্নত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি চূড়ান্ত করতে। অথচ এ মার্কো রুবিও কাতারে হামলার পর ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর তেল আবিবে সফর করেন। দোহায় আরব-মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে মার্কো রুবিও ইহুদিদের ধর্মীয় টুপি মাথায় দিয়ে জেরুজালেমে ইহুদিদের প্রধান প্রার্থনাস্থল ওয়েস্টার্ন ওয়ালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রার্থনায় অংশ নেন। সেখানে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় মার্কো রুবিও যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।

সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত হামাসের নেতাদের ওপর আবারও হামলার হুমকি দিয়ে বলেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ওপর আবার হামলা হবে। কারণ, তারা আমাদের বৈধ লক্ষ্যবস্তু। তেল আবিব সফরের একদিন পরই তিনি কাতারে সফর করেন। দোহায় পৌঁছে মার্কো রুবিও গাজায় যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের ভূমিকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গাজা যুদ্ধে যদি বিশ্বের কোনো দেশ মধ্যস্থতা করতে পারে, তবে সেটি কাতার। তারাই এটি করতে পারে। রুবিও বলেন, কাতারের সঙ্গে আমাদের একটি ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা একটি উন্নত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে কাজ করছি, যা চূড়ান্ত করার দ্বারপ্রান্তে।

কাতারের সঙ্গে আমেরিকার নতুন করে প্রতিরক্ষা চুক্তিকে কাতারের আমির শেখ তামিমকে বোকা বানানোর কৌশল হিসেবেই দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষক মহল। গত ২৩ মে মধ্যপ্রাচ্যের সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাতারকে আশ্বস্ত করেছিলেন, যদি কখনও কাতার বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়, তবে ওয়াশিংটন দেশটিকে রক্ষা করবে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ট্রাম্পের আশ্বাসসত্ত্বেও কাতারকে ইসরায়েলের হামলা সম্পর্কে কিছু জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি কাতারের আমির শেখ তামিম; বরং যে আমেরিকার ইশারায় ইসরাইল দোহায় হামলা চালাল তার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কাছে নালিশ জানাতে হামলার একদিন পর ওয়াশিংটন ছুটে যান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র থাকার পরও ইরানের মতো ইসরাইলের মাটিতে পাল্টা হামলাও করার সাহস করেনি মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী এ দেশটি। এর মাধ্যমে কাতার মূলত তার নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে।

সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, কাতারের ওপর এ হামলা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই হয়েছে। কারণ, কাতারে এ হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী দেশ যেমন- সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েতকে একটি পরোক্ষ বার্তা দিল যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আসলে তাদের রক্ষাকর্তা কেউ নেই। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত ও আধুনিক শক্তিশালী অস্ত্র নিয়েও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না। পাশাপাশি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র চুক্তি করে বিশাল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সেই অস্ত্র বিপদের সময় তাদের রক্ষা করতে পারে না। কারণ, এসব অস্ত্র পরিচালনার অনেক কারিগরি দক্ষতার জন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে।

আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা আরব রাজতন্ত্রগুলো যে বোঝে না, তা নয়। বুঝলেও জনবিচ্ছিন্ন আরব রাজতন্ত্রগুলো ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে বরাবরই আমেরিকাকে রক্ষাকবচ মনে করে থাকে। রাজা-বাদশাদের বদ্ধমূল ধারণা, আমেরিকাকে ক্ষেপালে যেকোনো মুহূর্তে জনগণকে উস্কে দিয়ে রাজতন্ত্রের মসনদ উল্টে দিতে পারে। মূলত এ ভয় থেকেই মার্কিন মোড়ালিপনা তারা চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা আরব রাজতন্ত্রগুলোকে মার্কিনিদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে বাধ্য করেছে। তবে কাতারের মতো ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্রের মাটিতে ইসরাইলের বর্বরোচিত আক্রমণ আরব দেশগুলোকে তাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা গ্যারান্টার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো ক্রমশ সতর্ক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বর্ধিত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করছে। যার প্রমাণ ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব এবং পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের পারস্পরিক ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা চুক্তিস্বাক্ষর।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসন উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হবে। চুক্তিস্বাক্ষরের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আলিঙ্গন করছেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির, যিনি দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। এ চুক্তির আওতায় সৌদি আরবকে পারমাণবিক ছায়া দিতে পাকিস্তান বাধ্য কিনা জানতে চাইলে পাকিস্তানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এটি একটি বিস্তৃত প্রতিরক্ষা চুক্তি, যা সকল সামরিক উপায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, চুক্তিটি একটি মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল অঞ্চলে কৌশলগত হিসাব পরিবর্তন করতে পারে। ওয়াশিংটনের মিত্র উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা উদ্বেগ সমাধানের জন্য ইরান এবং ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে এতদিন। কিন্তু গাজা যুদ্ধ এ অঞ্চলকে উল্টে দিয়েছে এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতার বছরে দু’বার সরাসরি আঘাতের শিকার হয়েছে একবার ইরান এবং একবার ইসরায়েল কর্তৃক।

এমতাবস্থায় আমেরিকার দ্বিচারিতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও মোড়ালিপনার ওপর তিক্তবিরক্ত আরব রাষ্ট্রগুলো সৌদি আরবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তানের পাশাপাশি রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের মতো দেশের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তিস্বাক্ষরের পথে এগোতে পারে। দোহায় সদ্য সমাপ্ত আরব-ইসলামি সম্মেলন থেকে ন্যাটোর আদলে ‘জয়েন্ট আরব ফোর্সেস’ বা যৌথ আরব বাহিনী গঠনের তাগিদ উঠেছে। ন্যাটো জোটভুক্ত প্রত্যেকটি দেশ যেমন- জোটের কোনো একটি দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে ওই দেশের নিরাপত্তায় সেনা সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ যৌথ আরব বাহিনীও সেভাবেই কাজ করবে বলে প্রস্তাব তোলা হয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এ যৌথ আরব বাহিনী গঠনের প্রস্তাব তোলেন।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত