ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহ্য ও অবদান

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহ্য ও অবদান

দারুল উলুম দেওবন্দ উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকে দেওবন্দি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৮৫৭ সালের বিপ্লব ও যুদ্ধে ইংরেজ বেনিয়াদের জয়ের ফলে এ দেশের শত শত স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয় এবং হাজার হাজার যোদ্ধাদের বন্দি করা হয়। মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) দেওবন্দের একজন বিজ্ঞ আলেম। তিনিও এ বন্দিদের মধ্যে ছিলেন। তিনি থানাভবন ও শামেলির ময়দানে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর ওপর ওয়ারেন্ট জারি হলে তিনি প্রায় দুবছর আত্মগোপনে থাকেন। এরপর ইংরেজ সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হলে তিনি জনসম্মুখে আসেন। আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তবে এবার তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি এমন সব তরুণ ও যুবক তৈরি করবেন, যারা দ্বীনে মুহাম্মদি সংরক্ষণের পাশাপাশি ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নেবে। এ লক্ষ্যে তিনি ১৮৬৬ সালে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন।

মহানায়কদের বিপ্লবের ধারা : এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র ছিলেন মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি। যিনি রেশমি রুমাল আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং ভারতের স্বাধীনতায় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) এ লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন, এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এমন মুজাহিদ ও সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠবে, যারা ভারতের স্বাধীনতায় অনন্য অবদান রাখবে। এখানের প্রথম ছাত্র মাওলানা মাহমুদ হাসান তার লক্ষ্যকে পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। তিনি শিক্ষা সম্পন্ন করে এখানেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ নেতৃত্ব দিতে থাকেন। মাওলানা মাহমুদ হাসান সর্বপ্রথম তার শিক্ষক মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর আদেশে ‘সামারাতুত তারবিয়া’ নামের একটি যুবসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। যুবকদের ইংরেজবিরোধী লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। এর মাধ্যমে অনেক যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে ইংরেজবিরোধী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু ইংরেজ গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯০৯ সালে আবার তরুণ ও যুবাদের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত করতে ‘জমিয়তুল আনসার’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের দায়িত্ব তার প্রিয় শিষ্য মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধির হাতে ন্যস্ত করেন। এ সংগঠনে হাজারের অধিক তরুণ নাম লেখায়। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এ সংগঠনের ওপরও পড়ে এবং এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

প্রবাসী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা : ১৯১৩ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান ‘নাজ্জারাতুল মাআরিফ’ নামের আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এ প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে থাকেন। হাকিম আজমল, ভিকারুল মুলক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মুহাম্মদ আলী এবং মাওলানা মঈন মনসুর আনসারি এ সংগঠনে কাজ করেন। মাওলানা মাহমুদ হাসান সশস্ত্র বিপ্লব ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ দখলদার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি ‘আজাদ হিন্দ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, রাশিয়া, জার্মানি এবং তুরস্কে প্রতিনিধি ও ডেলিগেটস পাঠান। এ সশস্ত্র বিপ্লবের লক্ষে দেশের বাইরে বাহিনী প্রস্তুত করেন। গোপনে দেশের ভেতরেও বিশাল বাহিনী তৈরি রাখেন; যারা দেশে বিদ্রোহ শুরু করবে এবং বিদেশিদের সহযোগিতা নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করে দিল্লি দখলে নেবেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বপ্রথম মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে ১৯১৫ সালে কাবুল পাঠান এবং আফগান সরকারের সাহায্য নিয়ে বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব দেন। মাওলানা সিন্ধি কাবুল পৌঁছে সেখানে ‘প্রবাসী ভারত সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেন। যার ওপর আফগান, জার্মান, ইরান তুরস্কের সমর্থন ছিল। এ সরকারে মহেন্দ্র প্রতাপ সিংকে রাষ্ট্রপতি, মাওলানা বরকত উল্লাহ ভূপালীকে প্রধানমন্ত্রী এবং মাওলানা সিন্ধিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

রেশমি রুমাল আন্দোলন : তুর্কি খেলাফতের সাহায্য নিতে মাওলানা মাহমুদ হাসান হেজাজ সফর করেন। হেজাজে তুর্কি গভর্নর গালিব পাশার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী তুর্কি বাহিনী বাগদাদ হয়ে বেলুচিস্তান সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করবে। এ পরিকল্পনাটি গোপনে একটি রেশমের রুমালে লিখে ভারতে পাঠানো হয়। ইতিহাসে যা ‘রেশমি রুমাল আন্দোলন’ নামে বিখ্যাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওই চুক্তিনামা পাঞ্জাবে সিআইডির হাতে ধরা পড়ে। ফলে মাওলানা মাহমুদ হাসানকে মক্কায় হুসাইন আহমদ মাদানি, ওয়াহিদ আহমদ দেওবন্দি, আজিজ গুল পেশওয়ারি ও হাকিম নুসরত হুসাইনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। মাল্টার দ্বীপে তাদের তিন বছর সাত মাস বন্দি রাখা হয়। এ বয়োঃজ্যেষ্ঠ বুজুর্গ আলেমদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ৮ জুন ১৯২০ সালে মাল্টার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বোম্বে বন্দরে পৌঁছালে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতের সব জাতীয় নেতা একত্রিত হন। এ সময় কেন্দ্রীয় খেলাফত কমিটি তাকে ‘শাইখুল হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভারত পৌঁছে শাইখুল হিন্দ আলেমদের এক জাতীয় প্লাটফর্ম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে জনগণকে স্বাধিকার আদায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশবিরোধী তার ঐতিহাসিক ফতোয়া দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারপন্থী মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের একটি দল আলিগড় ছেড়ে শাইখুল হিন্দের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। (আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, দারুল উলুম দেওবন্দ : ইতিহাস, ঐতিহ্য, অবদান : ১৯৬-২০৯)।

প্রতিষ্ঠাকাল ও অবদান : দারুল উলুম দেওবন্দ উপমহাদেশের সেই সুবিশাল জ্ঞাননিকেতন, যা গত শতাব্দীতে ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব জন্ম দিয়েছে। মুসলিম উম্মাহকে ফিকরি ও আমলি পথনির্দেশনা দিয়ে ইতিহাসে মজবুত অবস্থান ও সুদূর প্রভাব তৈরি করেছে। কয়েকজন মর্দে মুজাহিদ সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা জাগরুক রাখা, ইলমণ্ডআমল, ঈমান-আকিদা ও ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সুমহান বাস্তব কর্মসূচি হাতে নেন। এ মহান কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য রূপায়ণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির ইঙ্গিতে মাওলানা কাসেম নানুতবির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারতের সাহারানপুরের দেওবন্দ নামক স্থানে (১৮৬৬ সালের ৩০ মে) ১৫ মহররম ১২৮৩ হিজরি (বৃহস্পতিবার) প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিখ্যাত ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ মাদরাসা। (মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, যার যা ধর্ম, ‘দেওবন্দের দারুল উলুম’)। এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) বলেছিলেন, এটি নিছক বিদ্যালয়ের নাম নয়; বরং ইসলাম তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের মজবুত দুর্গ। এটি হচ্ছে মুজাহিদদের সেনানিবাস। বরেণ্য ব্যক্তিদের মতে, দারুল উলুম দেওবন্দ হচ্ছে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের পর ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলিত রাখার উচ্চ মিনার। বৃটিশ বেনিয়াদের ইসলামবিদ্বেষী চক্রান্ত মোকাবিলায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে একটি পরোক্ষ সংগ্রামের নাম দারুল উলুম দেওবন্দ। একটি প্রতিষ্ঠানই দেওবন্দের আসল পরিচয় নয়। দেওবন্দ একটি জাতি-গোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিশ্বমোড়লে তার পরিচয়। অস্তিত্বের প্রান্ত কিনারায় লড়ে যাওয়া স্বাধীনতার চেতনাকামী একঝাঁক আলেমের পদদলিত হওয়ায় আজও লোক মুখে ‘দেওবন্দ’। বিশ্বকে আরেকবার তাক লাগানো পরাশক্তির ভীত কাঁপানো কাফেলার ত্যাগেই দেওবন্দ। দেওবন্দ একটি ইতিহাস, একটি সংগ্রাম, একটি আন্দোলন। দেওবন্দি শুধু নির্দিষ্ট কোনো জাতি-গোষ্ঠির সঙ্গে সীমিত নয়; আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্য নামই ‘দেওবন্দি বা কাসেমি’। এককথায়, মুসলিম উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী, ধর্মীয় রাহবার, সফলতার অগ্রনায়ক এক গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত নাম ‘উলামায়ে দেওবন্দ’। (হাফেজ আকবর শাহ সংকলিত মাকালাতে মুফতিয়ে আজম : ৪৫)।

দেওবন্দের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা : বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। একদিকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তার, অন্যদিকে বিভ্রান্তিকর মতবাদ ও উগ্রপন্থার উত্থান ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ প্রেক্ষাপটে দারুল উলুম দেওবন্দের ভূমিকা একটি আদর্শ পথনির্দেশক। তাদের শিক্ষা ও চিন্তার গভীরতা, সঠিক ইসলামি মূল্যবোধের অনুশীলন, সমাজ সচেতনতা এবং আত্মিক উন্নয়ন- সব মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীর মুসলিম সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল বাতিঘর দারুল উলুম দেওবন্দ। দারুল উলুম দেওবন্দ একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি ঐতিহাসিক আন্দোলন; যা ধর্মীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। আজও এ প্রতিষ্ঠান থেকে যে আলো ছড়ায়, তা পুরো উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। (সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ১/৪৮১-৪৮২)। দেওবন্দ শুধু অতীতের গৌরব নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও এক প্রেরণার উৎস। দেওবন্দের প্রভাব শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়; পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, এমনকি আরব বিশ্বেও এ ধারার আলেমরা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার কাজ অব্যাহত রেখেছেন। আজও বাংলাদেশের লাখ লাখ ছাত্র দেওবন্দি পাঠক্রম অনুযায়ী ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। দেওবন্দ ছাড়া এ উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করা যাবে না। দেওবন্দ শুধু সুউচ্চ ইতিহাসের অংশ নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি। এ অঞ্চলের মানুষের আজাদি সংগ্রামের ঐতিহাসিক চারণভূমি এবং চেতনার স্মারক।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত