প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
নামকরণ ও উপাধি : ইরান শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফার্সি শব্দ ‘এরাম’ থেকে। অর্থ- ‘আর্যদের দেশ বা ভূমি’। এটি প্রাচীন শব্দ; যা এ অঞ্চলের আর্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত। একসময় শব্দটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগলিক সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে একটি জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করতে শুরু করে। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বে ইরানকে সাধারণত ‘পার্সিয়া’ নামে উল্লেখ করা হতো। আধুনিককালের ‘পার্সিয়ান’ নামটি সাধারণত সমস্ত ইরানি নাগরিকদের জন্য উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবশ্য পরিভাষাটি ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন : ইরান পশ্চিম এশিয়ার দেশ। এটি মোটামুটি ত্রিভুজাকৃতির। এর বাহু প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। উত্তর-পশ্চিমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান, উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পূর্বে তুর্কমেনিস্তান, পূর্বে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান, দক্ষিণে পারস্য ও ওমান উপসাগর এবং পশ্চিমে তুরস্ক ও ইরাক অবস্থিত। ইউরেশিয়ার কেন্দ্রে ও হরমুজ প্রণালির কাছাকাছি হওয়ায় দেশটি ভূকৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ইরান বর্তমানে ৩১টি প্রদেশে বিভক্ত। এটি বিশ্বের ১৭তম সর্বাধিক জনবহুল দেশ। ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পৃথিবীর সপ্তদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র।
জনসংখ্যা ও আয়ুষ্কাল : বিংশ-শতাব্দীর শেষার্ধে ইরানের জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আদমশুমারির তথ্যমতে, দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৯১.৫ মিলিয়ন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জন্মহার প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ১৪.৩ জন; মৃত্যুহার প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ৫.৩ জন। ইরানিদের গড় আয়ু ৭৫.৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষের ৭৪.৩ এবং নারীর ৭৭.১ বছর।
ইতিহাস-ঐতিহ্য : ইরানের ইতিহাস তিন ভাগে বিভক্ত। যথা-
প্রাগৈতিহাসিক যুগ : প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১ লাখ বছর আগে এ অঞ্চলে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে এ যুগের সমাপ্তি ঘটে।
প্রাথমিক যুগ : এ যুগ মূলত খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধজুড়ে বিস্তৃত। তখন ইরানি মালভূমির বিভিন্ন অংশে গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর প্রাথমিক রূপ।
রাজবংশীয় যুগ : এ যুগ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত। এ সময়ে গড়ে ওঠে পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্য। শুরু হয় ইতিহাসে ইরানের দৃশ্যমান উত্থান। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় ইরানি ইতিহাসে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের ভিত্তি।
রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা : ইরান প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেশ। এর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন পর্যায়ে এর বিবর্তন ঘটেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের উত্থান ছিল ইরানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এরপর সেলুসিড, পার্থিয়ান ও সাসানীয় সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্য ইরানের ভূমি শাসন করেছে। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র। ইরানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো-
প্রাচীন যুগ : ধারণা করা হয়, প্রায় ১ লাখ বছর আগে ইরানে মানুষের বসতি ছিল। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সঙ্গে ইরানের সম্পর্কও প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মেডিস রাজবংশ ইরানকে শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এরপর আসে আচেমেনিড সাম্রাজ্য; যা বিশ্বের প্রথম বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম।
পারস্য সাম্রাজ্য : আচেমেনিড সাম্রাজ্যের পর সেলুসিড, পার্থিয়ান ও সাসানীয় সাম্রাজ্য ইরান শাসন করে। এ সাম্রাজ্যগুলো ইরানের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও স্থাপত্যে ব্যাপক অবদান রাখে।
ইসলামি যুগ : সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিম আরবদের দ্বারা ইরান বিজিত হওয়ার পর ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ইরান মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। ফলে ইসলামি সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে।
সাফাভি সাম্রাজ্য : ১৫০১ সালে সাফাভি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ইরানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাফাভিদরা শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে ইরানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবর্তন আসে।
কাজর ও পাহলভি যুগ : সাফাভি সাম্রাজ্যের পর কাজর ও পাহলভি রাজবংশ ইরান শাসন করে। এ সময়কালে ইরান আধুনিকীকরণের পথে অগ্রসর হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র : ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ রেজা পাহলভির পতন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র। এ বিপ্লবের পর থেকে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি পায়। ইরানের এ দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস দেশটির সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
জাতীয়তা ও শাসন ক্ষমতা : জমহুরিয়ে ইসলামিয়ে ইরান বা ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরানের নীতিবাক্য হলো, স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র। জাতীয় সংগীত হলো, সোরুদে মেল্লিয়ে জমহুরিয়ে ইসলামিয়ে ইরান। রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী বা বসতি তেহরান। সরকারি ভাষা ফার্সি; অন্যান্য ভাষা- আর্মেনীয়, অশুরীয় নব্য-আরামীয়, আজেরি, কুর্দি, লরি, বেলুচি, আরবি ও তুর্কমেনীয়। ধর্ম শিয়া ইসলাম (রাষ্ট্রধর্ম), খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম ও জরথুস্ত্রবাদ। ইরানি, ইরানীয় ও পারসিক জাতীয়তাসূচক বিশেষণ। সরকার এককেন্দ্রিক খোমেনিবাদী রাষ্ট্রপতিশাসিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। রাষ্ট্রপতি মাসউদ পেজেশকিয়ান। উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ রেজা আরিফ। প্রধান বিচারপতি গোলাম হুসাইন মুহসিনি এজেই। আইনসভা ইসলামি মজলিসে শুরা।
বার্ষিক বাজেট : ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ইরানের সরকারি বাজেট ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রস্তুত করা হয়। এটি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে প্রথম বাজেট। এর মোট ব্যয় আনুমানিক ২,৪৬২,০০০ বিলিয়ন টমান। বাজেটে প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম ৩৫ শতাংশ রাখা হয়। সম্প্রচারের জন্য বাজেট বরাদ্দ ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভ্যাট ও ব্যক্তিগত আয়কর বৃদ্ধি করা হয়। ন্যূনতম মজুরি উপার্জনকারীদের জন্য ১০ শতাংশ ও উচ্চণ্ডআয়ের গোষ্ঠীর জন্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সম্পদ, যানবাহনের মালিকানা ও আবাসনের ওপর অতিরিক্ত কর চালু করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১৮ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়।
পেশা ও আয় : ইরানের অর্থনীতি মূলত একটি মিশ্র ও পরিবর্তনশীল। সেখানে একটি বৃহৎ সরকারি খাত বিদ্যমান। ইরানের জিডিপি প্রায় ৪৩৯.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় প্রায় ৫,৪১৫.২১ মার্কিন ডলার। তেল ও গ্যাস উৎপাদন ইরানের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জে ৪০টিরও বেশি শিল্প খাত অন্তর্ভুক্ত। ইরান খাদ্যদ্রব্য, বিশেষ করে আপেল, গম, যব, কমলা, আখ, আলু, পোলট্রি ও সবজি রপ্তানি করে। গোল্ডম্যান স্যাক্?সের প্রতিবেদন অনুসারে, একবিংশ শতাব্দীতে ইরানের বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইরানের অর্থনীতি ক্রয়ক্ষমতা সমতানুযায়ী বিশ্বের আঠারতম। বিশ্বের ১০ শতাংশ তেল ও ১৫ শতাংশ গ্যাস সঞ্চয়সহ ইরানকে পরমাণু শক্তিধর বলে গণ্য করা হয়। ইরানের প্রধান পেশা হলো তেল ও গ্যাস শিল্প। এ ছাড়া টেক্সটাইল, চিনি পরিশোধন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সিমেন্ট, নির্মাণসামগ্রী, লোহা, ইস্পাত ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য শিল্প। ইরানের অর্থনীতির ৬০ ভাগই তেল ও গ্যাস উৎপাদন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইরান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস মজুদ ধারণ করে। তেল ও গ্যাস ছাড়াও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে ইরান। যার মধ্যে রয়েছে পেট্রোকেমিক্যালস, ফল, কার্পেট ও অন্যান্য হস্তশিল্প।
শিল্পকলা ও সংস্কৃতি, কারুশিল্প : ইরানজুড়ে ছড়িয়ে আছে কার্পেটের তাঁত। প্রতিটি এলাকা নিজস্ব নাম বহনকারী বিশেষ নকশা ও মানের কার্পেটের জন্য বিখ্যাত। এগুলো স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত ও রপ্তানি করা হয়। হাতেবোনা কাপড়শিল্প আধুনিক টেক্সটাইল মিলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে। তাঁতিরা মখমল, মুদ্রিত সুতি, উলের ব্রোকেড, শাল ও কাপড়ের জুতা তৈরি করে। খোরাসান তার ফিরোজা কাজের জন্য ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল তার প্রাকৃতিক মুক্তোর জন্য পরিচিত। কারুশিল্পের কৌশলগুলো পণ্যের মতো ভিন্ন। ইসফাহান, শিরাজ ও তেহরানের অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারের জন্য কাঠের অসংখ্য সাজসজ্জার জিনিসপত্র উৎপাদিত হয়। তেহরানে মেশিনের তৈরি সিরামিক টাইলস তৈরি করা হয়। পাথর ও মাটি বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালির সরঞ্জাম, ট্রে, থালা ও ফুলদানি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। মাশহাদ পাথরশিল্পের কেন্দ্র। সারাদেশে মৃৎশিল্প ব্যাপক হারে ছড়িয়ে রয়েছে। হামাদান এর বৃহত্তম কেন্দ্র।
স্থাপত্য : ইরানে গভীর স্থাপত্যের ঐতিহ্য রয়েছে। এলামাইট, আচেমেনিয়ান, হেলেনিস্টিক ও অন্যান্য প্রাক-ইসলামি রাজবংশ তাদের মহত্ত্বের আকর্ষণীয় পাথরের সাক্ষ্য রেখে গেছেন। ইসলামি যুগ থেকে সেলজুক, ইল-খানিদ ও সাফাভিদ রাজবংশের স্থাপত্যের সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে সময়ে নিশাপুর, ইসফাহান ও শিরাজের মতো শহরগুলো ইসলামি বিশ্বের মহান শহরগুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়। তাদের অনেক মসজিদণ্ডমাদ্রাসা, মাজার ও প্রাসাদ স্থাপত্য-ঐতিহ্য গঠন করে। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ইরানি স্থাপত্য কাউন্সিল পশ্চিমাদের অন্ধ অনুকরণকে নিরুৎসাহিত করে। আধুনিক চাহিদা পূরণে পরিবর্তিত ঐতিহ্যবাহী ইরানি শৈলীর ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়। পাহলভি স্থাপত্য কর্মসূচির আকর্ষণীয় উদাহরণ হলো শাহিয়াদ বা শাহের স্মৃতিস্তম্ভ টাওয়ার। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের নামানুসারে এর নাম ‘আজাদি বা স্বাধীনতা টাওয়ার’ রাখা হয়।
ভাষা-সাহিত্য : ইরানি সংস্কৃতি তার সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। নবম শতাব্দীতে তার বর্তমান রূপে আবির্ভূত হয়। ফার্সি ভাষার মহান গুরু ফেরদৌসি, নিজামি, হাফেজ, জামি ও রুমি আধুনিক যুগে ইরানি লেখকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। যদিও রক্ষণশীল ধর্মযাজকদের দ্বারা অশ্লীল বলে বিবেচিত অনেক ধ্রুপদী রচনার প্রকাশনা ও বিতরণ কঠিন ছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ফার্সি সাহিত্য পশ্চিমা সাহিত্যিক ও দার্শনিক ঐতিহ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তবু ইরানি সংস্কৃতির জন্য এটি প্রাণবন্ত মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে। গদ্য হোক বা কবিতা, তা প্রভাবশালী ইরানি লেখকদের জন্য সাংস্কৃতিক আত্মদর্শন, রাজনৈতিক ভিন্নমত এবং ব্যক্তিগত প্রতিবাদের বাহন হিসেবে কাজ করে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর অনেক ইরানি লেখক নির্বাসনে যান। পরবর্তীতে দেশের সেরা ফার্সি ভাষার সাহিত্যের বেশিরভাগই বিদেশে লেখা ও প্রকাশিত হয়। তবে বিপ্লব-পরবর্তী যুগে শাহরনৌশ পারসিপুর ও মনিরু রাভানিপুরের মতো লেখকদের দ্বারা নতুন সাহিত্যের জন্ম হয়।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান : ইরানে খুব কম জাদুঘর রয়েছে। যেগুলো আছে, সেগুলো তুলনামূলক সাম্প্রতিক উৎপত্তি। দুটি ব্যতিক্রম হলো, তেহরানের গুলিস্তান প্রাসাদ জাদুঘর। যা ১৮৯৪ সালে খোলা হয়। অন্যটি জোলফা (ইসফাহান)-এর সর্ব ত্রাণকর্তার ক্যাথেড্রাল জাদুঘর। যা ১৯০৫ সালে আর্মেনীয় সম্প্রদায় দ্বারা নির্মিত। শিল্পের জন্য নিবেদিত একমাত্র গ্যালারি হলো তেহরান আধুনিক শিল্প জাদুঘর। এটি ১৯৭৭ সালে খোলা হয়। অন্যান্য সুপরিচিত জাদুঘরের মধ্যে রয়েছে ইরানের জাতীয় জাদুঘর (১৯৩৭), তেহরানের নেগারস্তান (১৯৭৫) ও শিরাজের পারস (১৯৩৮)। তেহরানে অবস্থিত জ্ঞানী সমাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাচীন ইরানি সাংস্কৃতিক সমাজ, ইরানি গণিত সমিতি ও ইরানি মাইক্রোবায়োলজি সোসাইটি। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর জন্য নিবেদিতপ্রাণ বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
খেলাধুলা ও বিনোদন : কুস্তি, ঘোড়দৌড় ও ধর্মীয়ভাবে শরীরচর্চা ইরানের ঐতিহ্যবাহী খেলা। বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে দলগত খেলাধুলা চালু হয়। এর মধ্যে জনপ্রিয় রাগবি ফুটবল ও ভলিবল। ইরানি ক্রীড়াবিদরা ১৯৪৮ সালে প্রথম অলিম্পিক গেমসে অংশ নেন। ইরানের বেশিরভাগ অলিম্পিক পদক এসেছে ভারোত্তোলন, মার্শাল আর্ট ও কুস্তি ইভেন্টে। ইরানে ফুটবল বেশ জনপ্রিয়। দেশটির দলটি ১৯৬৮, ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপে আত্মপ্রকাশ করে; কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিপ্লব ইরানি খেলাধুলার জন্য বড় ধাক্কা ছিল। ফুটবলের জন্য বিপুল জনসমর্থন সহজে দমানো যায়নি।
মিডিয়া ও প্রকাশনা : দৈনিক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হয় তেহরানে। ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা মন্ত্রণালয় ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি পরিচালনা করে। বিশেষ অনুষ্ঠানে বিদেশি সংবাদদাতাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকারের অভ্যন্তরে রক্ষণশীল ব্যক্তিদের দ্বারা সম্প্রচার মাধ্যম ও ইন্টারনেটের ওপর সেন্সরশিপ ব্যাপক। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ইরানে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রসারে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও জার্নাল ব্যাপক অবদান রাখে। সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ইত্তিলাআত’ ও ‘কাইহান’। ইরানের রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্রগুলো সরকার দ্বারা পরিচালিত। অনুষ্ঠানগুলো ফার্সি ও কিছু বিদেশি ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষা ও উপভাষায় সম্প্রচারিত হয়।
সামরিক সক্ষমতা : গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র?্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম। প্রতিরক্ষা খাতে দেশটির বাজেট ৯৯৫ কোটি ডলার। নিয়মিত সেনা আছে ১১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে রিজার্ভ সৈন্যসংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৫৫১টি। এর মধ্যে যুদ্ধ বিমান আছে ১৮৬টি, অ্যাটাকিং বিমান সংখ্যা ২৩টি, পরিবহন বিমান আছে ৮৬টি, প্রশিক্ষণ বিমান ১০২টি। হেলিকপ্টার আছে ১২৯টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ১৩টি। ট্যাংক আছে ১৯৯৬টি এবং সাঁজোয়া যান আছে ৬৫ হাজার ৭৬৫টি। রকেট আর্টিলারি এমএলআরএস-এর সংখ্যা ৭৭৫টি এবং সেল্ফ প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৫৮০টি। ১০১টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে; যেখানে ৭টি ফ্রিগেট এবং ২১টি টহল জাহাজ। সাবমেরিন আছে ১৯টি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র
ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি, ইউরেনিয়ামের মজুদ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে ইরান।
যুদ্ধ-বিপ্লব : ইরানের যুদ্ধ-বিপ্লবকে দুটি প্রধান অংশে ভাগ করা হয়। যথা-
ইরানি বিপ্লব (১৯৭৯) : এ বিপ্লব ছিল ইরানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ; যা ১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয়। এর ফলে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পশ্চিমা-সমর্থিত শাসনের অবসান ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র। এ বিপ্লবের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা প্রভাবের বিরোধিতা, সামাজিক অবিচার ও রাজনৈতিক নিপীড়ন।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮) : এ যুদ্ধ ছিল ইরান ও ইরাকের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত। ১৯৮০ সালে ইরাক ইরানের ওপর আক্রমণ করে। ফলে যুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধটি উভয় দেশের জন্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে আনে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালে সমাপ্ত হয়। যুদ্ধটি শেষ হওয়ার পর ইরান উপসাগরের শাতিল আরব জলাধার লাভ করে।
আধিপত্যের যত কারণ
আঞ্চলিক মিত্রতা ও প্রক্সি শক্তি : ইরান বারবার দেখিয়েছে, পারস্য জাতি মাথানত করে না। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ও অবরোধের মধ্যেও ইরান সামরিক, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক শক্তিতে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান শুধু অভ্যন্তরীণ সংহতি বজায় রাখেনি, বরং আঞ্চলিক মিত্র ও প্রক্সি শক্তি হিজবুল্লাহ, হুতি, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়াগোষ্ঠীর মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
অক্ষুণ্ণ কঠোর শাসনব্যবস্থা : বিগত কয়েক দশকে বহুবার পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েল ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ সামরিক অভিযানেও নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এ হামলা ইরানে সরকার পরিবর্তনের পথ খুলে দেবে। এমনকি সর্বোচ্চ নেতা খামেনিকে হত্যার ছক কষেছিলেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে ইরানের শাসনব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রয়েছে; বরং অভ্যন্তরীণভাবে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
নতুন ও অভিনব কৌশল : নানা সংঘাত, সামরিক প্রতিরোধ, কূটনৈতিক কৌশল ও অভ্যন্তরীণ সংহতির মাধ্যমে ইরান নতুন এক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একক আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে ইরান এখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। পারস্য জাতি প্রমাণ করেছে, তারা মাথা নত করে না; বরং ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে জানে। ইরান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ বিপ্লব কেবল দেশটির ইতিহাসের নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ।