ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পীর জুলফিকার নকশবন্দির ইন্তেকাল

হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
পীর জুলফিকার নকশবন্দির ইন্তেকাল

প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট সুফিসাধক মাওলানা পীর হাফেজ জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি মুজাদ্দেদি (৭২) গত রোববার ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের শীর্ষ বুজুর্গ আলেম ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের জংগ জেলায় তার জন্ম। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। ৪০ বছর বয়সে তিনি এ পেশা থেকে অবসর নিয়ে সর্বাত্মকভাবে দীনের পথে আত্মনিয়োগ করেন। একাধারে হাফেজে কোরআন, আলেম, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার এবং নকশবন্দি তরিকার শায়খ হিসেবে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে এক বিরল ও বৈচিত্রপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী ছিলেন তিনি।

শিক্ষাদীক্ষা ও খেদমত : বড় ভাই মাস্টার আহমদ আলীর তত্ত্বাবধায়নে প্রাইমারি লেখাপড়া শেষ করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৭১ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে বিএস ও ১৯৭৬ সালে ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে বিএস পাস করেন। এছাড়া তিনি লম্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিউম্যান রিসোর্স কোর্স সম্পন্ন করেন। আধুনিক জ্ঞানের পাশাপাশি তিনি একজন হাফেজে কোরআন ছিলেন। জিয়াউল উলুম নামক মাদ্রাসায় মুফতি ওয়ালিউল্লাহ ও মুফতি জামিল আহমদ থানবির কাছে পড়াশোনা করেন। তার ছিল আল্লাহর প্রতি অসামান্য ভালোবাসা, রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ ও আত্মত্যাগ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ শরিয়তের অনুসরণ। সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য মুরিদ ও ছাত্র। পৃথিবীর আনুমানিক ৩০টি দেশে ইংরেজি এবং উর্দুতে তিনি ইসলামি বিষয়ে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছেন। প্রতি বছর মালয়েশিয়ায় ৩ দিনের ইজতিমায় তার উপস্থিতি এবং বক্তব্য বিশেষ আকর্ষণের ছিল।

হাদিসের সনদ হাসিল : তিনি বোখারি পড়েছেন জামিয়া জিয়াউল উলুম পাকিস্তানে শাইখুল হাদিস আল্লামা ইয়াকিরের কাছে। তখন পাকিস্তান বেফাক বোর্ডের জন্ম হয়। তিনি বারবার তার উস্তাদকে বলেন, ‘হজরত! আমার ইচ্ছা, বেফাক বোর্ডে দাওরা পরীক্ষা দেব।’ কিন্তু উস্তাদ জবাবে বলেন, ‘তুমি সনদ চাও না ইলম চাও?’ তখন নকশবন্দি বলেন, ‘হজরত! ইলম চাই।’ উস্তাদ বলেন, ‘তাহলে আমি যে ইলম তোমাকে দান করেছি, এতে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। আমিও কোনো বোর্ডে পরীক্ষা দিইনি।’ সে সময় পাকিস্তানের অনেক মাদ্রাসা বেফাক বোর্ডে যোগ দেয়নি। উস্তাদের কথা মেনে তিনি বেফাক বোর্ডের পরীক্ষা অংশ নেননি। অন্যথায় বোর্ডের প্রথম ছাত্র হওয়ার সম্ভবনা ছিল। তাকে পাকিস্তানের দুটি প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদ দিয়েছে- এক. জামিয়া রহমানিয়া জাহানিয়া মিন্ডী, দুই. জামিয়া কাসিমুল উলুম মুলতান। তার রয়েছে হাদিসের চারটি সনদ- ১. দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা সালেম কাসেমি (রহ.) তাকে তার বিশেষ কক্ষে নিয়ে হাদিসের দরস দিয়ে সনদের অনুমতি দেন। ২. হারামে মক্কার এক সময়ের শাইখুল হাদিস আহমদ আলী (ভারত) তাকে হাদিসের অনুমতি দেন। যার কাছ থেকে মুফতি তাকি উসমানিও হাদিসের অনুমতি পেয়েছেন। ৩. তুর্কিতে তাকে হাদিসের অনুমতি দিয়েছেন শায়খ আমিন সিরাজ। ৪. বোখারার সমরকন্দে সিরিয়ার আরেক শায়খ তাকে হাদিসের অনুমতি দিয়েছেন। যা মাত্র পনের সনদে রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে। এ সনদে রয়েছেন আল্লামা শামি (রহ.)।

খেলাফত : ১৯৪৩ সালে খাজা গোলাম হাবিব নকশবন্দি (রহ.) তাকে খেলাফত ও ইজাজত দান করেন। যুবক বয়সে জুলফিকার আহমদ নকশবন্দির একশবার রাসুল (সা.)-এর জেয়ারত নসিব হয়। সৌদি আরব, মিসর, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আমেরিকা (২২ প্রদেশ), উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান, গিরগিস্তান, তাতারিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, আফগানিস্তান, হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, জার্মান, নরওয়েসহ প্রায় ৭০টি রাষ্ট্রে দাওয়াতি সফর করে ইসলাম সম্পর্কে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন তিনি। লাখো মানুষ তার কাছে তাওবা করেছেন। অনেকে তার হাতে মুসলমান হয়েছেন। বিশ্বে তার দেড়শ খলিফা রয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলেন করাচিতে মুফতি আবু লুবাবা। যিনি পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ দরসগাহ জামিয়াতুর রশিদের মুহাদ্দিস ও মুফতি। ভারতে মাওলানা খলিলুর রহমান সাজ্জাদ নোমানি। যিনি মাওলানা মনজুর নোমানি (রহ.)-এর ছেলে। সাউথ আফ্রিকায় মাওলানা ইমাম শামিল।

মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশনা : ১৯৮৪ সালে দারুল উলুম জংগ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে জামিয়া আয়েশা সিদ্দিকা নামে মেয়েদের জন্য আলাদা মাদ্রাসা শুরু করেন। যার পরিচালক হলেন তার স্ত্রী। মাহাদুল ফকির আল-ইসলামিয়া নামে একটি জামিয়া নির্মাণ করেন। যেখানে দারুল ইফতাসহ অনেকগুলো শাখা রয়েছে। ১৯৯৯ সালে মাকতাবাতুল ফকির নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। যেখান থেকে লক্ষাধিক কিতাবাদি ছাপা হয়েছে। এছাড়া তার অসংখ্য ইসলামি বিষয়ের আলোচনা সংবলিত উর্দু বয়ানের অনুবাদ বাংলায় হয়েছে। যা ৩২ খণ্ডে ‘খুতুবাতে জুলফিকার’ নামে বাংলা ভাষায় সহজলভ্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত