ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পর্যটন

পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত

পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত

চট্টগ্রামের বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত যেন বাংলাদেশের একটি অফুরন্ত অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের নাম। বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া, গণ্ডামারা, কাথরিয়া, সরল, বাহারছড়া, খানখানাবাদের উপকূলজুড়ে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকত। কতই না সুন্দর এই সৈকত। সৈকতের পূর্ব পাশে সারি সারি ঝাউ গাছ। উপকূল জুড়ে ঘন ঝাউ বাগান। জোয়ার-ভাটার ঢেউয়ে পর্যটকদের মন কাড়া শব্দ। সাগরের উপকূল জুড়ে বেড়ে ওঠা কেওড়া ও ঝাউবনে ঘেরা সবুজ এক দৃষ্টিনন্দন সৈকত ঘিরে চলে দিবানিশি জোয়ার-ভাটার খেলা। এতে নানা সৌন্দর্যে মুখরিত বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত যেন দেশের পর্যটন শিল্পের নতুন এক সম্ভাবনাময় নাম। বাঁশখালীর সমুদ্র তীরের ছনুয়া, কদমরসুল, খানখানাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে সৈকতের সৌন্দর্য চোখে পড়ে। ভাটার টানে সৈকতের বিশাল প্রশস্ততা চোখে পড়ে। এছাড়া কক্সবাজার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের চেয়েও এখানকার সৈকত অনেক বেশি প্রশস্ত। তবে বর্ষাকালে প্রশস্ততা কিছুটা কমে আসে। ১৯৯১ সাল থেকে বেশ কয়েকটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় এই এলাকার বেড়িবাঁধ তছনছ করে দিয়ে গেছে। ফলে পর্যটনের সৌন্দর্য সেখানে বিকশিত হচ্ছে না। সমুদ্র তীরে শক্ত বেড়িবাঁধ দেওয়া হলে, এবং ভাঙন প্রতিরোধ হলে এটাই হতে পারে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত।

এদিকে সমুদ্র লাগোয়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ওপর ভিত্তি করে গড়া এই সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি বাঁশখালীবাসীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের। এজন্য পর্যটন বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে স্থানীয়রা। তাছাড়া পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জোর দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন স্থানীয় পর্যটনপ্রেমীরা। স্থানীয়রা জানান, জাতীয় দিবস, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনের বাঁশখালীর উপকূলীয় সমুদ্র সৈকত হাজারো লোকের পদচারণায়মুখর হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগর উপকূলজুড়ে ২৫ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের ৭ পয়েন্টে দেখা মিলে হাজার হাজার পর্যটকের। তবে রাস্তাঘাটের বিপণ্ণতা এবং রাতযাপনের জায়গা না থাকায় তড়িঘড়ি করে পর্যটকরা আবার বাঁশখালী সদরে কিংবা নিজ বাসস্থানে চলে যান। তবে রাস্তাঘাট উন্নত, ভালো মানের আবাসিক হোটেল এবং পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলে কক্সবাজারের মতো বহু পর্যটকের ভিড় জমবে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর। তাদের দাবি বাঁশখালীর সমুদ্র ঘেঁষা উপকূলের ২৫ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতকে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা। স্থানীয় আরও জানান, ২০০৬ সালের দিকে বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত উপকুলে চারা লাগিয়ে বন বিভাগ ঝাউবন তৈরি করে। গাছগুলো বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্যও বেড়ে যায়। এর পর থেকে খানখানাবাদ ও বাহারছড়া পয়েন্ট স্থানীয় পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট হয়ে উঠে। স্থানীয়দের মতে, অপার সম্ভাবনাময় এই সমুদ্র সৈকতকে যথাযথভাবে উন্নয়ন ও পরিচর্যা করা হলে কক্সবাজারের বিকল্প সমুদ্র সৈকত হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই মতামতে একমত পোষণ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, অপার সম্ভাবনা বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে এখান থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হবে। পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়ে আশার আলো দেখছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও।

এতে তারা জানান, ‘বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে ছুটির দিনে প্রচুর পরিমাণে পর্যটক আসায় বেচা বিক্রি ভালোই হয়। কোথাও দম ফেলার সময় নাই তাদের। পর্যটকদের নিরাপত্তায় কোনো সমস্যা না হলে আগামীতেও আশাতীত পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে তাদের আশা। শহর থেকে থেকে আসা পর্যটক আবু ওবাইদা আরফাত বলেন, ঈদের পর নিজেকে একটু সময় দিতে প্রতিবারের মতো আমার প্রিয় জায়গা বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে ছুটে এলাম। সাগরের নীল জলরাশি দেখে মনটা জুড়িয়ে গেছে। আমার দেখা দেশের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত এটি।

আনোয়ারা থেকে আসা মোরশেদ হোসেন বলেন, দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পর এটি আমার চোখে দেখা সব চেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত। এখানে সবগুলো পর্যটন স্পটই উন্মুক্ত। তাই বরাবরের মতোই প্রকৃতির ইশারায় চলে আসি এখানে। ভালোই লাগছে।

শেখেরখীল এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী সাঈদ হোসেন চৌধুরী আরফাত বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এলাকার বিশাল চরে সারি সারি ঝাউ গাছের বাগান যেকোনো পর্যটনপ্রেমীর নজর কাড়ে। এখানে পর্যটনকেন্দ্র স্থাপিত হলে বিনোদন প্রেমীরা উপকৃত হবেন। এই অপার সম্ভাবনার সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দীর্ঘদিনের দাবি আমাদের। তাছাড়া এখানে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ঝাউবাগান সৃষ্টি করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করলে সরকার লাভবান হবে এবং বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।

চাম্বল এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান তালুকদার বলেন, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। এখানে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতের লাল কাঁকড়া সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য আরও অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এই বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত থেকে সরাসরি সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা। সমুদ্রের সঙ্গে গা ঘেঁষে রয়েছে কুতুবদিয়া চ্যানেল, আর নিকটেই দ্বীপ কুতুবদিয়া। পর্যটকরা চাইলে দ্বীপ ঘুরেও আসতে পারবেন। তবে রাস্তাঘাট আরও উন্নত হলে এখানে পর্যটকদের স্বর্গ হয়ে উঠবে। বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু মিয়া বলেন, ‘ছুটির দিনে বিপুল সংখ্যক পর্যটক বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে আসেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে। আমি নিজে উপস্থিত থেকে পর্যটকদের বিভিন্ন নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। পাশাপাশি সাদা পোশাকেও নজরদারি করা হয়। এছাড়া পর্যটকদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাহারছড়া ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বলেন, এক সময় বাঁশখালীর সমুদ্র সৈকতে যেতে পর্যটকরা ভয় পেত। সরকারের সহযোগিতায় আধুনিক ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ করে দেয়াতে এখন পর্যটকরা সহজেই সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতে পারে। বন্ধের দিনে এখানে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। বাঁশখালীর ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতকে সরকারীভাবে পর্যটন স্পর্ট ঘোষণার জোর দাবি জানাচ্ছি আমরা। আশা রাখি অচিরেই তা বাস্তবায়নের মুখ দেখবে। তাছাড়া বাঁশখালী উপকূলজুড়ে মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হলে এই পর্যটন এলাকার দৃশ্যপট এমনিতেই পাল্টে যাবে বলে মনে করি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদল নেতা বাহাদুর আলম হিরণ বলেন, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন স্পষ্ট। সরকারী সুযোগ-সুবিধা থাকলে কক্সবাজারকেও ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া বাঁশখালী একটি পর্যটন সমৃদ্ধ এলাকা। এখানে সমুদ্র সৈকত ছাড়াও ইকোপার্ক ও চা বাগান রয়েছে। রয়েছে বহু পুরাকীর্তি। এখানকার সমুদ্র সৈকতের বিশালত্ব যেকোনো বিনোদন প্রেমিককে আকৃষ্ট করে। ফলে পর্যটকরা একই সঙ্গে অনেক কিছু দেখার ইচ্ছা থাকলে অনায়াসে বাঁশখালীতে আসতে পারেন।’

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জামশেদুল আলম বলেন, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা একটি পর্যটন স্পট। এই সৈকতে সাগরের ঢেউয়ের পাশাপাশি সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। শিগগিরই এই সৈকতে টুরিস্ট পুলিশসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত