ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রমজানে সাহাবি ও আগেকার আলেমদের আমল

দিদার শফিক
রমজানে সাহাবি ও আগেকার আলেমদের আমল

রমজান ইবাদতের মাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে গোনাহমুক্ত জীবন গঠনের মাস। পাপাচার ও অশ্লীলতা বর্জন করে শুদ্ধ-বিমল সমাজ নির্মাণের উত্তম ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস। তাই যুগে যুগে বুজুর্গ আলেমগণ রমজান মাসে অধিক পরিমাণে আমল করতেন। আমলের রুটিন তৈরি করে সে অনুযায়ী জীবন যাপন করার প্রয়াস চালাতেন। যাতে নিজেকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। নবী (সা.)-এর পর তার দেখানো পথে সবচেয়ে বেশি আমল করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের পর তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িন ছিলেন উত্তম ও প্রবাদতুল্য আমলকারী। যুগে যুগে কোরআন ও হাদিসের আলেমগণ আমলের ক্ষেত্রে সদা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন নিজেরা সুন্নাহভিত্তিক আমল করে গ্রহণযোগ্যতা অর্জণের মাধ্যমে। সব যুগেই বুজুর্গ আলেমগণ নবী (সা.)-এর আনুগত্য করে আমলের পরিমাণ ও নিষ্ঠাগত মানকে সর্বদা ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। তারা নিজের মন মতো করে কিছু করতেন না। তবে আমলের সুবিধার্থে কোরআন ও হাদিসের সমর্থনে অধিক নেকিসংবলিত আমলগুলো করার ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ ও সহজতাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করতেন। নবী (সা.) ও সাহাবিদের আমলের অনুকরণ বুজুর্গ আলেমদের আমলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নবী (সা.) ও সাহাবিদের আমল তো ছিল সীমাহীন। নবী (সা.) ও সাহাবিদের মতো আমল করা আমাদের মতো দুর্বল উম্মতের পক্ষে খুবই কঠিন। তবুও যুগে যুগে আল্লাহর কিছু বান্দা থাকেন, যাদের যাপিত রমজান অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা হয়। এমনকিছু বান্দার রমজান যাপন ও আমলের ধরন নিয়ে এ নিবন্ধে আলোচনা করা হলো।

সাহাবা ও তাবেয়িদের কোরআন তেলাওয়াত : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কোরআনের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। রমজান মাসে তিনি প্রতি তিন দিনে একবার কোরআন খতম করতেন। (ফাজায়েলে কোরআন, আবু উবাইদ, পৃষ্ঠা : ১৮০)। বিখ্যাত তাবেয়ি ইমাম আসওয়াদ নাখায়ি (রহ.) মাগরিব এবং এশার মাঝে সামান্য ঘুমিয়ে নিতেন। সারারাত নামাজ তেলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। রমজান মাসে প্রতি দুই রাতে তিনি এক খতম কোরআন পড়তেন। রমজান ছাড়া অন্য সময় ছয় রাতে এক খতম পড়তেন। (ফাযায়েলে কোরআন, আবু উবাইদ, পৃষ্ঠা : ১৮০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা : ৪/৫১)। বিখ্যাত তাবেয়ি ইবরাহিম নাখায়ি (রহ.) রমজান মাসে প্রতি তিন দিনে একবার কোরআন খতম করতেন। রমজানের শেষ দশকে দুই রাতে একবার খতম করতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক : ৬১২৮)।

আবু যর (রা.) বলেন, যখন তুমি রোজা রাখবে, তখন তা হেফাজতের ব্যাপারেও সতর্ক থাকবে। বর্ণনাকারী তলীক ইবনে কায়সের আমলের অবস্থা ছিল এমন, তিনি রমজান মাসে ঘরে ঢুকতেন, নামাজের সময় ছাড়া আর বের হতেন না। এভাবে তারা রোজা হেফাজতে সচেষ্ট থাকতেন এবং কোনোভাবে যেন কোনো অনর্থক বিষয়ে জড়িয়ে না পড়েন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ৯১২২)।

কাতাদা (রহ.) সারা বছর তাহাজ্জুদ নামাজে প্রতি সাত দিনে এক খতম কোরআন পড়তেন। আর রমজানে প্রতি তিন রাতে এক খতম পড়তেন। রমজানের শেষ দশকে তিনি প্রতি রাতে এক খতম করে কোরআন পড়তেন। (হিলইয়াতুল আউলিয়া ২/৩৩৮-৩৩৯; লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃষ্ঠা : ১৭১)।

যুগ শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের আমল : ইমাম যুহরি হাদিসের বড় একজন ইমাম। উঁচু মাপের মুহাদ্দিস। জগৎজুড়ে তার সুখ্যাতি। এ মহান ইমাম রমজান আগমন করলে হাদিস চর্চা ও অন্যান্য শিক্ষাবিষয়ক ব্যস্ততা স্থগিত করে তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, এখন তেলাওয়াতের মাস উপস্থিত হয়েছে এবং মানুষের মেহমানদারি করার সময় এসেছে। (লাতায়েফুল মাআরেফ : ১৭১)। আরেকজন বিখ্যাত ফকিহ আলেম ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.)। রমজান মাস এলে তিনি অন্যান্য নফল ইবাদতের চেয়ে তেলাওয়াতের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করতেন। (লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃষ্ঠা: ১৭১)। ইমাম মালেক (রহ.)। তিনি চার মাজহাবের চার ইমামদের একজন। মুয়াত্তা ইমাম মালেক তার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ’। এ মহান ইমামও রমজান মাস আগমন করলে সব ব্যস্ততা কমিয়ে এবং সকল ইলমি ব্যস্ততা বন্ধ রেখে পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন। (লাতায়েফুল মাআরেফ : ১৭১)। ইমাম বোখারি (রহ.)। তাকে বলা হয় আমিরুল মুহাদ্দিসিন ফিল হাদিস। সহি বোখারি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। হাদিসশাস্ত্রের মহান এ ইমাম তাহাজ্জুদ নামাজে এক-তৃতীয়াংশ কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এভাবে প্রতি তিন রাতে একটি করে খতম করতেন। (তবাকাতে হানাবেলা : ১/২৭৫)।

দান ও মেহমানদারির আমল : ইমাম শাফেয়ি (রহ.)। চার মাজহাবের বিখ্যাত চার ইমামের একজন তিনি। তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর অনুসরণে রমজান মাসে দান-খয়রাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। কারণ মানুষের অনেক প্রয়োজন থাকে। আর অনেকে এ মাসে ইবাদতে অধিক মশগুল থাকার ফলে তাদের আয় রোজগার কম হয়। (মুখতাছারুল মুযানি : ৭৮৮)। হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান (রহ.) রমজানে প্রতি রাতে পঞ্চাশজনের মেহমানদারি করতেন। ঈদ এলে তাদের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতেন। আর ঈদের দিন তাদের ১০০ দেরহাম করে হাদিয়া দিতেন। (আলকামেল, ইবনে আদি : ৩/৭; মুখতাছারুল মুযানি : ৭৮৮)।

বিশিষ্ট আলেমদের রমজান পালন : রমজান মাসে রোজাদারকে ইফতার করানো অনেক আলেমের স্বাভাবিক আমল ছিল। ভারত উপমহাদেশে কোনো কোনো অঞ্চলে এটা ছিল অঞ্চলগত ঐতিহ্য। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হজরত যাকারিয়া (রহ.) বলেন, কান্ধালায় আমাদের ঐতিহ্য ছিল ইফতারের আগে এক ডেগ পোলাও প্রস্তুত করা। অতঃপর ছোট ছোট পাত্রে পরিমাণ মতো বিভিন্ন ঘরে নারীদের জন্য পাঠানো হত। অবশিষ্ট যা থেকে যেত তা নিয়ে বাড়ির উঠানে বসা হত। মুরব্বিরা সবাই এখানে শরিক হতেন এবং পথচারীকে ডেকে এনে ইফতার করানো হত। সবাই ইফতার করে মাগরিবের নামাজে যেতেন এবং এশা পর্যন্ত নফলে মশগুল থাকতেন। (আকাবির কা রমজান : ৬২)।

মুফতি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) : তিনি ফকিহ ও বিশিষ্ট আবেদ ছিলেন। তাসাউফের উচুঁ স্তরের সাধক ছিলেন। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ এ সাধক আলেম ভীষণ অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও আমলে খুব যত্নশীল ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারতেন না। তবুও এই বয়সে সারাদিন রোজা রাখার পর তার ইবাদতে কোনো ঘাটতি হত না। তিনি মাগরিবের পর দীর্ঘ রুকু সেজদাসহ আওয়াবিন পড়তেন। রমজান ছাড়া অন্য সময় ছয় রাকাত পড়লেও রমজানে পড়তেন বিশ রাকাত। এই বিশ রাকাতে তিনি কমপক্ষে দুই পারা কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এরপর এশা ও তারাবি পড়তেন ঘণ্টাখানিক সময় নিয়ে। তিনি এই নামাজগুলো দাঁড়িয়েই আদায় করতেন। রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে বিশ্রামে যেতেন। আবার দুইটা-আড়াইটার মধ্যে তাহাজ্জুদের জন্য উঠে যেতেন। কখনো কখনো একটা বাজেই উঠে যেতেন। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন।

নামাজের প্রতি তার গভীর নিমগ্নতা লোকমুখে প্রসিদ্ধ ছিল। ফজরের পর সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত জিকির করতেন। জোহর নামাজের পর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতেন। আসর পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। মাঝেমধ্যে সেই বন্ধ ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। তিনি রমজানের প্রতিনি মুহূর্তকে আমলে ব্যয় করার চেষ্টা করতেন। নামাজের আগে পরে ঘরে আসা-যাওয়ার সময়গুলোতে কারো সঙ্গে কথা না বলে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন। রমজানে প্রতিদিন নামাজে এবং নামাজের বাইরে সব মিলিয়ে প্রায় পনের পারা তেলাওয়াত করতেন। (আকাবির কা রমজান; শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.) : ১৮-২০,৬৬)।

মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) : মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) দারল উলূম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নামাজে দীর্ঘ কেরাত পড়তেন। একাকী পড়তেন। সাথে কেউ শরিক হলে তিনি তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে সালাম ফিরিয়ে তাকে ফারেগ করে দিতেন। আবার নিজে দাঁড়িয়ে লম্বা কেরাতে নামাজ পড়তে থাকতেন। (আকাবির কা রমজান : ২৩)।

মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.) : কোরআনপ্রেমী এক বুজুর্গ ব্যক্তির নাম মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী রহ.। তিনি সাহারানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদিস ছিলেন। শাইখুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর শায়েখ ও উস্তাায ছিলেন। সুনানে আবু দাউদের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ’ ‘বযলুল মাজহুদ’ এর রচয়িতা তিনি। রমজানে দিনের শুরুতে ফজর থেকে ইশরাক পর্যন্ত তিনি মুরাকাবা করতেন। এরপর থেকে ১১টা পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। ‘বযলুল মাজহুদ’ লেখার সময় শীতকালে ১২টা পর্যন্ত আর গরমকালে ১টা পর্যন্ত লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন। এরপর জোহর পর্যন্ত সামান্য বিশ্রাম নিতেন। জোহরের পর কোনো হাফেজ সাহেবকে সোয়া এক পারা তেলাওয়াত শোনাতেন। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাসবিহ পড়তেন।

মাগরিবের পর নফল নামাজে সোয়া এক পারা তেলাওয়াত করতেন। তবে অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে আরো সময় নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। তাহাজ্জুদ পড়া ছিল তার নিয়মিত আমল। অভ্যাস অনুযায়ী সুবহে সাদিকের দুই-তিন ঘণ্টা আগে উঠে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। দুই থেকে আড়াই পারা তেলাওয়াত করতেন। আর রমজান মাসে হজরতের তেলাওয়াতের পরিমাণ দুই থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেত। রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের দুই বছর আগে যখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখনও তিনি ইতেকাফ বাদ দেননি। (আকাবির কা রমজান : পৃ. ৭-১৮; ফাযায়েলে রমজান, যাকারিয়া (রহ.) : ৬-৭)।

শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) : শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) নিজে হাফেজ ছিলেন না; কিন্তু তারাবির পর প্রায় সারারাত নামাজে থাকতেন। তার নামাজের জন্য কয়েকজন হাফেজ সাহেব নিযুক্ত ছিলেন। তিনি তাদের খুব সমাদর করতেন। খাবার-দাবার ও অন্যান্য বিষয়ে খেয়াল রাখতেন এবং তাদের জন্য সম্মানজনক ব্যবস্থা করতেন। হাফেজ সাহেবগণ পালাক্রমে দুই চার পারা পড়িয়ে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি সাহরি পর্যন্ত এভাবে নামাজে তেলাওয়াত শুনতেন। দিনের বেলা এক আধটু বিশ্রাম নিলেও তিনি রাতে তেমন বিশ্রাম নিতেন না। কখনো কখনো এশার নামাজ পড়ে ঘরে চলে আসতেন। হাফেজ সাহেবদের নিয়ে দীর্ঘ সময় তারাবি পড়তেন। চার পারা, ছয় পারা এমনকি দশ পারা পর্যন্ত তারাবি নামাজে তেলাওয়াত শুনতেন। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পড়তে তার পা ফুলে যেত।

(সাওয়ানেহে শাইখুল হিন্দ আছগরি, আকাবির কা রমজান : ২৬-২৮, সূত্র: আল কাউসার)

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা আইডিয়াল সিটিজেন মাদ্রাসা, মানিকনগর, মুগদা, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত