মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার (রহ.) আলি ইবনে আবি তালেব (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন, আবদুল মুত্তালিব বলেছেন, আমি হিজরে ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন এসে আমাকে বলল, তিবা খনন করো। জিজ্ঞাসা করলাম, তিবা কী? সে চলে গেল। পরের দিন যখন আমার বসতঘরে শুয়েছি, সেই লোক আবার আমার কাছে এসে বলল, জমজম খনন করো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, জমজম কী? বলল, এটি সেই কুয়া যা কোনো দিন শুকাবে না বা পানি কম হবে না। বিপুলসংখ্যক হাজীর পানির চাহিদা মেটাবে। এই কূপ রক্ত ও পুঁজের মাঝখানে এমন জায়গায় আছে, যেখানে লাল চঞ্চু ও নখরবিশিষ্ট কাকেরা মাটি ঠোঁকরায় এবং সেখানে পিঁপড়াদের বাসা আছে। আবদুল মুত্তালিবের কাছে যখন জমজম কূপের জায়গা ও গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে গেল এবং বুঝতে পারলেন যে, তিনি সত্য স্বপ্ন দেখেছেন পরদিন ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে কোদাল হাতে সে জায়গায় আসলেন। তখনও পর্যন্ত তার ছেরে সন্তান ছিল একজন। তিনি স্বপ্নে দেখানো জায়গাটি খনন করা শুরু করলেন। ‘কূপের ঢাকনা পাথরটি চিহ্নিত হওয়ার পর তিনি তাকবির দিলেন। তখন কুরাইশরা বুঝতে পারল যে, আবদুল মুত্তালিবের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তখন তারা আবদুল মুত্তালিবের কাছে এসে বলল, এই কূপ আমাদের পিতা ইসমাইলের। এতে আমাদেরও অধিকার আছে। এতে আপনার সঙ্গে আমাদেরও অংশীদার করতে হবে।
আবদুল মুত্তালিব বললেন, এ কাজ আমি কিছুতেই করব না। এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আমার সঙ্গে জড়িত। তোমাদের মধ্য থেকে আমাকেই এটি দান করা হয়েছে। কুরাইশের লোকেরা বলল, আপনিই বিচার করুন। আমরা কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না। এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমরা ঝগড়ায় যেতে প্রস্তুত আছি। আবদুল মুত্তালিব বললেন, তোমরা যে কোনো লোককে ঠিক করবে আমি তাকে সালিশ মানব। তারা বলল, বনু সাআদ ইবনে হুজাইমের গণক আমাদের সালিশ হতে পারেন। আবদুল মুত্তালিব বললেন, ঠিক আছে। এই জ্যোতিষী থাকেন মাআন অঞ্চলে- যা সিরিয়ার অন্তর্গত।
আবদুল মুত্তালিব তার পৈতৃক সম্বন্ধযুক্ত আত্মীয়-স্বজন বা আবদু মুনাফের কয়েকজন সন্তানকে নিয়ে রওনা দিলেন। কুরাইশদের প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে লোক কাফেলার সাথি হলো। তারা যাত্রা করল এবং তাদের যাত্রাপথ ছিল ধুধু বালুরাশির মাঝ দিয়ে। কাফেলা হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি মরুভূমিতে পৌঁছার পর আবদুল মুত্তালিব ও তার সঙ্গীদের পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যায়। তারা এমন তৃঞ্চার্ত হয়ে পড়ে যে, তাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। আবদুল মুত্তালিব সফরসঙ্গী অন্যান্য কুরাইশ গোত্রগুলোর কাছে পানি চাইলেন। তারা বলল, আমরাও একই সমস্যায় আছি। আমরাও মরুপথের যাত্রী। আমাদের আশঙ্কা আপনাদের দশা যেন আমাদের না হয়।
আবদুল মুত্তালিব যখন তাদের এ আচরণ দেখলেন এবং সঙ্গী সাথিদের প্রাণনাশের আশঙ্কা করলেন তখন সফরসঙ্গীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়। তারা সবাই বলল, আমরা আপনাকে মান্য করি। এ পরিস্থিতিতে আপনি যে আদেশ করবেন তাই আমরা পালন করব। তিনি বললেন, আমার তো মনে হয় আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। শরীরের শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমরা প্রত্যেকে নিজের জন্য গর্ত খনন করি। আমাদের মধ্যে যেই মৃত্যুবরণ করবে অন্যরা তাকে ওই গর্তে তার ওপর মাটি চাপা দেবে, দাফন করবে। তাতে করে সর্বশেষ একজন লোকের লাশ মাটির ওপরে থাকবে। সবার লাশ মাটির ওপরে থেকে যাওয়ার চেয়ে মাত্র একজনের লাশ পড়ে থাকা অনেক উত্তম। সবাই বলল, এই নির্দেশনা খুবই সুন্দর।
এরপর সবাই নিজ নিজ কবর খনন করল। এরপর তারা অপেক্ষা করতে লাগল। তৃঞ্চায় কখন কার প্রাণ য়ায়, সেই প্রতীক্ষা সবার মাঝে।
এ পরিস্থিতিতে আবদুল মুত্তালিব সাথিদের বলল, আমরা যেভাবে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি তাও কিন্তু আমাদের চরম হীনমন্যতা ও কাপুরুষতা। আমরা আরেকটু চেষ্টা করা কি ভালো হবে না? আমরা কি নিজের প্রাণ রক্ষার কোনো উপায় খঁুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি না? হয়তো আল্লাহতায়ালা এই বিশাল ভূখণ্ডের কোথাও আমাদের পানি নসিব করতে পারেন। কাজেই চলো সবাই বাহনে সওয়ার হও। আবদুল মুত্তালিবের সাথিরা বাহনে উঠে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। কুরাইশদের অন্যান্য বংশের লোকেরাও অপেক্ষা করছিল, তারা কী করে দেখি।
আবদুল মুত্তালিব তার উটনির কাছে গেল। উটনি যখন নড়ে উঠল এবং আবদুল মুত্তালিবকে পিঠে নিয়ে দাঁড়াল। তখনই আবদুল মুত্তালিবের জুতার নিচ থেকে একটি সুপেয় পানির ঝর্না উথলে উঠল। তখন আবদুল মুত্তালিব তাকবির বললেন এবং তার সাথিরাও তাকবির ধ্বনি দিয়ে উঠল। সে মুহূর্তে সবাই বাহন থেকে নেমে পড়ল। আবদুল মুত্তালিব নিজে এবং তার সাথিরা পানি পান করল। তাদের পানির পাত্রগুলো ভর্তি করল। এরপর অন্যান্য কুরাইশ গোত্রকে আহ্বান জানাল, তোমরা এসো, পানি পান কর, পাত্র ভর্তি কর। আল্লাহ আমাদের পানির দ্বারা পরিতৃপ্ত করেছন। তারা আসল, পানি পান করল এবং পাত্রগুলোতে পানি ভর্তি করল। তারা এবার বলল, আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে ফায়সালা করে দিয়েছেন। খোদার কসম এরপর থেকে আর আমরা আপনার সঙ্গে জমজমের মালিকানা নিয়ে ঝগড়া করব না। যে আল্লাহ মরুভূমিতে আপনার জন্য পানির ব্যবস্থা করেছেন তিনিই আপনাকে জমজম কূপ দান করেছেন। চলো আমরা ফিরে যাই। হাজীদের পানি খাওয়ানোর মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব এখন থেকে আপনিই পালন করবেন। এ পর্যায়ে তিনি ফিরে আসলেন। অন্যরাও তার সঙ্গে ফিরে আসল। গণকের কাছে আর গেল না। জমজমের ব্যাপারটি তারা আব্দুল মুত্তালিবের ওপর ছেড়ে দিল। জমজম কূপ খনন সম্পর্কে এটি ছিল স্বতন্ত্র একটি রেওয়ায়াত বা বর্ণনা।
অপর এক রেওয়ায়াতে ঘটনার বিবরণ এভাবে এসেছে। আবদুল মুত্তালিবকে বলা হয় যে, তুমি জমজম কূপ খনন করো। কূপটি খনন করলে তুমি অনুতপ্ত হবে না। কেননা, তা তোমার পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার এটি কখনই শুকাবে না বা পানি হ্রাস হবে না। বিপুলসংখ্যক হাজী তার দ্বারা পরিতৃপ্ত হবে। (ইবনে হিশাম, ১/১৫৪)।
ইবনে ইসহাক বলেন, এ কথাটি আব্দুল মুত্তালিবকে বলার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন সেই কূপ কোথায়? বলা হলো, পিঁপড়ার বাসার পাশে, যেখানে কাকেরা মাটি ঠোকরায়। আবদুল মুত্তালিব পরদিন ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে সে স্থানে গেলেন। তিনি পিঁপড়ার বাসা দেখতে পেলেন। আরও দেখলেন যে, দুই মূর্তি এসাফ ও নায়েলার মাঝখানের সেই জায়গায় কাক মাটি ঠোকরাচ্ছে। (এসাফ স্থাপিত ছিল সাফা পাহাড়ের ওপর আর নায়েলা মরওয়া পাহাড়ের ওপর। (শরহে জুরকানি, ১/৯৫)।
মূর্তি দুটি ছিল কুরাইশের। কুরাইশরা তাদের বলিগুলো এই দুই মূর্তির পায়ে জবাই করত। আবদুল মুত্তালিব কোদাল নিয়ে এসেছিলেন এবং নির্দেশিত জায়গায় খননকার্য শুরু করে দেন। কুরাইশরা যখন তার চেষ্টা তদবির দেখল তার কাছে এসে বলল, আমরা আপনাকে আমাদের দুই মূর্তির মাঝখানে খনন করতে দেব না, যেখানে আমরা আমাদের বলিগুলো জবাই করে থাকি।
আবদুল মুত্তালিব তার ছেলে হারেসকে বললেন, তুমি আমার পাহারায় থাক, আমি যাতে খননকার্য চালিয়ে যেতে পারি। আল্লাহর কসম আমি আমার দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবো না। কুরাইশরা যখন দেখল, তিনি নাছোড়বান্দা তখন তাকে আপন হালে ছেড়ে দিল। খানিকটা খনন করার পরই তিনি কূপের ঢাকনা পাথরের সন্ধান পেলেন। তখনই তিনি তাকবির দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার স্বপ্ন সঠিক ও শুদ্ধ ছিল। আরও বেশি খনন করার পর তার মধ্যে দুটি স্বর্ণের হরিণ পেয়ে গেলেন। জুরহুম সম্প্রদায় মক্কা ছেড়ে যাবার সময় হরিণ দুটি এই কূপের মধ্যে দাফন করেছিল। এ ছাড়া কয়েকটি কিল্লাই তরবারি ও বর্ম কূয়ার মধ্যে পেয়ে গেলেন। (কিল্লাই ভারত ও ইয়ামেনে দুটি স্থানের নাম- তাজুল আরুস)। কুরাইশরা তাকে বলল, আপনি কূয়া থেকে যা কিছু পেয়েছেন তাতে আমাদেরও হক আছে। তিনি বললেন, না তা হবে না। তবে একটা লটারি দিই। লটারিতে যা সাব্যস্ত হয় সে অনুযায়ী মালিকানা সাব্যস্ত হবে।
কুরাইরশরা বলল, সেই লটারি কীভাবে নির্ধারিত হবে। তিনি বললেন, কাবাঘরের নামে দুটি কাঠের তীরের ফলা নির্ধারণ করি, দুটি তীর আমার নামে এবং তোমাদের নামে দুটি তীর। প্রত্যেকের নামের তীরে যে যে জিনিসের নাম বেরিয়ে আসে, সেগুলো তার হয়ে যাবে। যার নামে শূন্য লেখা তীর বেরিয়ে আসবে, সে কিছুই পাবে না। তারা বলল, আপনি ইনসাফের কথা বলেছেন।
আবদুল মুত্তালিব কাবাঘরের নামে দুটি তীরের কাঠি নির্ধারণ করলেন। তীর দুটির রং হলুদ বর্ণের। কালো রঙের দুটি ফলা নির্ধারণ করলেন তার নিজের নামে। আর দুটি সাদা তীর নির্ধারণ করলেন কুরাইশদের জন্য। তিনি তীরের ফলাগুলো লটারি টানার লোকটির হাতে দিলেন। এই লোক কাবাঘরের অভ্যন্তরে স্থাপিত কুরাইশদের সবচেয়ে বড় মূর্তি হুবলের কাছে লটারি টেনে থাকে। আব্দুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে দোয়া প্রার্থনা শুরু করেন। লটারি টানার লোক যথানিয়মে লটারি টানল। তাতে দুটি ফলা- যার গায়ে দুটি স্বর্ণের হরিণের নাম লেখা, কাবাঘরের নামে বেরিয়ে এলো। আর দুটি কালো বর্ণের তীরের ফলা- যার ওপর তরবারি ও বর্মের নাম লেখা ছিল, আব্দুল মুত্তালিবের নামে বেরিয়ে এলো। আর দুটি তীর ছিল শূন্য লেখা, এগুলো কুরাইশের নামে উঠে আসে।
আব্দুল মুত্তালিব তরবারিগুলো কাবাঘরের দরজা নির্মাণের খাতে কাজে লাগান। আর দুটি স্বর্ণের হরিণকে স্থাপন করা হয় কাবাঘরের দরজায়। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/১৮৭-১৯১)। এ ছিল প্রথম স্বর্ণ, যা দিয়ে কাবাঘরকে অলঙ্কৃত করা হয়। বলা হয়েছে যে, কাবাঘরের তালা ও চাবি নির্মাণ করা হয় দুটি হরিণের স্বর্ণ দিয়ে। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৪৬, সিরাতুন নবী, ১/ ১৫৫ ভাষাগত তারতম্যসহ)।