প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৩ নভেম্বর, ২০২৫
দুজন মানুষ একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে বিয়ের মাধ্যমে। অসংখ্য স্বপ্নের লালন করে এক মধুময় সম্পর্কে জড়িয়ে দুজন মানুষ বুনতে থাকে স্বপ্নের জাল, গড়ে তোলে স্বপ্নের সংসার। আজীবন সেই স্বপ্নমাখা জীবন কাটানোর আশায় অকৃত্রিম ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে শুরু হয় তাদের বর্ণিল পথযাত্রা। সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে দুজনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। কিন্তু কখনও দেখা যায়, কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। না চাইতেও কিছু সংসারে দেখা যায় ডিভোর্সের কালো ছায়া। ভেঙে যায় স্বপ্নের প্রাসাদ। ধ্বংস হয় সম্পর্ক। এতদিনের সব সুখস্মৃতি ভুলে দুজন দুই ছাদের নিচে বসবাস করতে শুরু করে। আসলে যেকোনো বিচ্ছেদই পীড়াদায়ক। হোক তা বন্ধুত্বের কিংবা বৈবাহিক বন্ধনের। তারপরও মানুষ বিচ্ছেদকে বরণ করে নেয়। সুখের সন্ধানে একাকিত্বকে বেছে নেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে বিচ্ছেদপ্রবণতা কেন বাড়ছে? কেন মানুষ বৈবাহিক জীবন ছেড়ে একাকী জীবন বেছে নিচ্ছে? এটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলেছেন, তা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব।
বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবনদর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, সন্দেহপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা, পর্দা রক্ষা করা, পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা, যৌতুকবিহীন বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শারীরিকভাবে অক্ষম হলে বিয়ে থেকে বিরত থাকা এসবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এসব মানা হয় না বিধায় প্রতিনিয়ত বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে।
ইসলামে ডিভোর্সের প্রতি নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বিয়েবিচ্ছেদের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল হচ্ছে তালাক।’ (ইবনে মাজাহ : ২০১৮)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘যে নারী তার স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।’ (ইবনে মাজাহ : ২০৫৫)।
দাম্পত্যজীবনে দুজনের মধ্যে মতের অমিল হতেই পারে। রাগ-অভিমান, মনোমালিন্য থাকতেই পারে। পৃথিবীতে সমস্যা যেমন হতে পারে, তেমনি থাকে উত্তরণেরও অনেক উপায়। এ জন্য সাংসারিক জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হলে সর্বপ্রথম তা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। সম্ভাব্য সব সমাধানের পথে বিচরণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবে। প্রথমত উভয়কেই ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং সন্দেহপ্রবণতা ছেড়ে দিতে হবে। একপক্ষ মানিয়ে চলবে আর অন্যপক্ষ ঔদ্ধত্য স্বভাবের হলে ‘শান্তি’ ও ‘সুখ’ নামক শব্দ সংসার থেকে বিদায় নেবে। এ জন্য দুজনেরই ছাড় দেওয়ার মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।
ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়াসী হওয়া। তালাক ও বিয়েবিচ্ছেদের পর্যায়টি হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়, যা অনিবার্য প্রয়োজনের স্বার্থেই বৈধ রাখা হয়েছে। এ জন্য যথাসম্ভব মনোমালিন্য দেখা দিলে নিজেরাই মিটমাট করে নেবে, যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা হয় তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা নিসা : ৩৫)। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করে দেওয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহ তায়ালা তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দেবেন। কাজেই বিয়েবিচ্ছেদের আগে এই কোরআনি শিক্ষা অনুসরণ করা কাম্য।
দাম্পত্য জীবন সুদৃঢ় রাখতে ও মধুময় করে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয় স্বামীকে। দাম্পত্যের মেরুদণ্ড কীভাবে সুদৃঢ় থাকে, সংসারের চাকা কীভাবে সচল থাকে এটা স্বামীকেই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে লক্ষ করতে হবে। পৃথিবীর সফলতম স্বামী ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর জীবনী আমরা অনুসরণ করতে পারি। রাসুল (সা.) নিয়মিতই স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন। ভালো কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা ও অভিবাদন জানাতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে থেকে খাদিজা (রা.)-এর চেয়ে অন্য কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ঈর্ষাপোষণ করিনি। কারণ রাসুল (সা.) প্রায়ই তাঁর কথা স্মরণ করতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।’ (বোখারি : ৫২২৯)।
মনের বিষণ্ণতা দূর করার জন্য মানুষ অন্যের কাছে নিজের প্রিয় মানুষটার সমালোচনা করে বেড়ায়। এতে করে সংসারে কলহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় এবং সুখ-শান্তি চলে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।’ (সুরা হুমাজাহ : ১)। আর স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দোষ বলে বেড়ানো তো আরও ভয়াবহ বিষয়।
সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল সমাজের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ঘরের ভেতর আল্লাহর রাসুল (সা.) স্ত্রীদের সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতেন। হজরত আসওয়াদ (রহ.) বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবীজি (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ‘ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারের কাজে সহায়তা করতেন। অতঃপর সালাতের সময় হলে সালাতে চলে যেতেন।’ (বোখারি : ৬৭৬)।
অনেক পরিবারে স্ত্রী সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও স্বামীর মন পায় না। সামান্য ত্রুটি চোখে পড়লেই স্বামীরা কথা শোনায়। এটা চরম অন্যায় ও জুলুম। স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ভালো যে তার পরিবারের কাছে ভালো। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)। মনে রাখতে হবে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের অনুগামী করে। পুরুষ যেমন ব্যবহার করবে, নারীও অনুরূপ ব্যবহারে অভ্যস্ত হবে। পুরুষের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নারীরও দায়িত্ব রয়েছে। তবে সংসারের পরিচালক হিসেবে প্রধান দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পিত। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা নবীজি (সা.) সর্বোত্তম আদর্শ। দাম্পত্য জীবনের স্ত্রীর প্রকৃত আবেগ, অনুভূতি ও চাহিদা সম্পর্কে সম্যক অভিহিত হওয়াও নবিজীর অন্যতম সুন্নাত। স্ত্রীর প্রতি এমন অবস্থান গ্রহণ করা প্রত্যেক নারীই পছন্দ করবে; যার ফলে স্বামীর কাছে স্ত্রীরা অর্ধাঙ্গিনীতে পরিণত হবে। নবীজি স্ত্রীদের হৃদয় উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতেন।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর উত্তম আচরণ ও মনোরম দাম্পত্য জীবনের এটিও একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্ত্রীদের নাম ধরে ডাকায়ও ছিল তার ভালোবাসা। তিনি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ তাদের নামকে সংক্ষিপ্ত করে ডাকতেন। আবার তার মন যেন খুশিতে ভরে যায় এমন সুসংবাদও দিতেন। স্ত্রীকে সাহায্য করা; তার সঙ্গে আন্তরিক ও বিনয়ী হওয়া; তাদের কাজে সহায়তা এবং তাদের বিনোদন, সুখ ও মজা দেওয়ায় কোনো স্বামীর সম্মান ও মর্যাদার কমতি হবে না। যেভাবে তার সম্মান ও মর্যাদার কমতি হয়নি। যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ ও দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতেও নবীজি দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীদের প্রতি ছিলেন কোমল। এসব ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা ও নমনীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো অভিযানের নেতৃত্ব, দীর্ঘ সফর, যুদ্ধের মহা বিজয়ও নবীজি (সা.)-কে ভুলিয়ে দেয়নি যে, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের দুর্বল স্ত্রী জাতি। তিনি উপলব্দি করেছেন, যাদের সুকোমল পরশ ও আন্তরিক ফিস ফি-সানির অধিকার এবং প্রয়োজনও তাদের রয়েছে। যা তাদের দীর্ঘ রাস্তার কষ্ট ও সফরের ক্লান্তি দূর করে দেবে।
স্ত্রীদের প্রতি এ সবই ছিল নবী (সা.)-এর সুখী দাম্পত্য জীবন ও সুন্দর চিত্ত বিনোদন এবং স্ত্রীর ব্যাপারে অসীম গুরুত্বারোপের বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় সর্বোত্তম আদর্শ। যার বাস্তবায়নে প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করবে জান্নাতি সুখ ও শান্তি।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক