ঢাকা সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কাকরাইল মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
কাকরাইল মসজিদ

তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রস্থল হওয়ার কারণে কাকরাইল মসজিদটি দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে অতি সুপরিচিত। মসজিদের পুরো নাম কাকরাইল মালউয়ালি জামে মসজিদ। মসজিদটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সাল তারিখ থাকলেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতভেদ পাওয়া যায়। কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বিদের কাছে থেকে জানা যায়, বর্তমান মসজিদ নির্মাণের পূর্বে এখানে নবাব পরিবারের নির্মিত স্বল্প পরিসরে একটি মসজিদ ছিল, যার অস্তিত্ব এখন আর নেই।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহম্মদ এলতাসউদ্দিন জানান, আমি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ওসমান গনির কাছে থেকে শুনেছি, এ মসজিদ নির্মাণে উদ্যোগী ছিলেন প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি আহমদ ও সমমনা কতিপয় ব্যক্তি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মসজিদ নির্মাণের জন্য সরকারের অনুমতি ও জায়গা চেয়ে আবেদন পাঠানো হলে দীর্ঘদিনেও কোনো অনুমতি পাওয়া যায়নি। সরকারের অনুমতি ছাড়াই এক রাতে শতাধিক লোক মিলে চারদিকে ইটের গাঁথুনি, বাঁশ ও টিন দিয়ে সেখানে তারা মসজিদ তৈরি করে ফজরের নামাজ আদায় করেন। বিষয়টি সরকারের নজরে এলে ডা. টি. আহমদ ও তার সহযোগীদের কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। পরে তিনি উকিলের মাধ্যমে জবাব দিলেন। পরে এ বিষয়টি নিয়ে আর কেউ কথা বলেনি। এভাবেই কাকরাইল মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।

ষাটের দশকে কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বিগণের সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম হাজি আব্দুল মুকিত সাহেবের তত্ত্বাবধানে তিন তলা মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেন। দুই একর জমিতে তিনতলা মসজিদ, পাঁচতলা মাদ্রাসা ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে।

বর্তমান মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় নকশায় তৈরি। এ মসজিদ নির্মাণের স্থাপত্য নিদর্শন দেখলে মনে হবে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম হাজি আব্দুল মুকিত সাহেব মনপ্রাণ ঢেলে মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। মসজিদের ছাদসংলগ্ন ত্রিভুজ আকৃতির নকশা রয়েছে। পিলারগুলো চৌকোণা আকৃতির। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালটি ঢেউ খেলানো। এছাড়াও মসজিদটির তিন দিকে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। দক্ষিণ ও উত্তর পাশে রয়েছে ওজুখানার জন্য ছোট্ট দুইটি পুকুরসাদৃশ্য হাউজ। এ পুকুরের চতুষ্পার্শে শতাধিক লোক একত্রে ওজু করতে পারেন। বাইরের দিকে রয়েছে ওজুখানা। মসজিদ থেকে একটু দূরে উত্তর পাশে ইস্তিঞ্জার জন্য রয়েছে দোতলা একটি ভবন।

এ মসজিদ থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম তাবলিগ জামায়াতের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তাবলিগ জামায়াতের মূল কথা হলো, ‘নিজে সৎকর্ম করা ও অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং অন্যকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা। তাবলিগের জন্য বিভিন্ন সময়ে আল্লাহতায়ালা নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। যেহেতু নবী করিম (সা.)-এর পরে আর কোনো নবী আসবেন না, তাই এই দাওয়াতি কাজের দায়িত্ব তার উম্মতকে দেওয়া হয়েছে।’

বিশ্ব ইজতেমাসহ বিভিন্ন সময়ে কাকরাইল মসজিদে অতিরিক্ত মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। অনেক সময়েই জায়গার সংকুলান হয় না। সরকারের কাছে মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জায়গা চাওয়া হলেও সরকার তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। অথচ গত ত্রিশ বছর ধরে মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম দিকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়ে আসছেন। যেহেতু তাবলিগের কাজটি একটি আন্তর্জাতিক কাজ, তাই অনতিবিলম্বে মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জায়গা বরাদ্দ দিতে সর্বস্তরের মুসল্লিগণ জোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

মসজিদে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাবলিগ জামায়াতের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ফজরের নামাজের পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিশেষ বয়ান। এর পরপরই মুসল্লিদের নিয়ে হেদায়েতের বয়ান শুরু হয়। তাবলিগ জামায়াতের কাজ কীভাবে করবে, সে বিষয়ে বয়ানের মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। দোয়া, তালিমে বসা, জিকির করা, নামাজ পড়া, খেদমত করা এবং মহল্লার লোকজনকে মসজিদে এনে তাবলিগের কাজে উদ্বুদ্ধ করা এখানের প্রতিদিনের আমল। সব শেষে দোয়া ও মোসাফা করে তাদের নির্ধারিত স্থানে জামায়াত নিয়ে যাওয়া। এ হেদায়েতের বয়ানে যারা জামায়াত থেকে ফিরে আসবে, তাদের কাজের বিষয়ে বিস্তারিত শোনা হয় এবং তারা স্ব স্ব এলাকায় গিয়ে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়। জোহরের নামাজের পরে হয় তালিম। তালিমের মধ্যে তিনটি বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১. কিতাব/হাদিস থেকে পড়া (ফাজায়েলে আমল ও মুন্তাখাব হাদিস) ২. সুরা-কেরাতের মষ্ক করা ৩. ছয় নম্বরের/ছয়টি গুণের ওপর আলোচনা। গুণ ছয়টি হলো, কালিমা (ঈমান), সালাত (নামাজ), ইলম (জ্ঞানচর্চা) ও জিকর, ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য), ইখলাসে নিয়ত (সংকল্পের একনিষ্ঠতা) এবং তাবলিগ। এ ছয়টি গুণ নিজের মধ্যে অর্জনের চেষ্টা করার গুরুত্বারোপ করা হয়। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দ্বীনের বয়ান করা হয়। বাদ মাগরিব সুরা ওয়াকিয়া পড়ে সম্মিলিত দোয়া, যারা জামায়াত থেকে ফিরেছে তাদের থেকে কারগুজারি শোনা এবং তাদের কাজের ধরন জানা হয়। মাগরিবের পরে কাকরাইলে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষায় বয়ান বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি লোকদের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া এবং যেসব মাসতুরাত জামায়াত (মহিলাদের জামাত) রয়েছে, তাদেরকে আগত মেহমানদের বয়ান ভাষান্তর করে মাইকের মাধ্যমে শোনানো হয়। এশার নামাজের পরে হায়াতুস সাহাবা গ্রন্থ থেকে পড়ে শুনানো হয় সাহাবিদের জীবনী। সবশেষে দোয়া করে সবাই বিশ্রাম চলে যায়।

কাকরাইল মসজিদের বিদেশি মেহমানদের জন্য রয়েছে থাকাণ্ডখাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা। বিশ্ব ইজতেমার সময়ে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার বিদেশি মেহমান এ মসজিদে অবস্থান করেন। বছরের অন্যান্য সময়ে এক থেকে দুই শতাধিক বিদেশি মেহমান থাকেন। বিদেশি মেহমানদের থাকা খাওয়ার বিষয়টি মসজিদের মুরুব্বিদের মাধ্যমে পরিচালিত ও মুসল্লিগণের স্বেচ্ছাশ্রমে হয়ে থাকে। বিদেশি মেহমানদের মসজিদে আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে ভাড়াবিহীন একাধিক মাইক্রোবাস।

পাঁচতলা ভবনে বিশিষ্ট কাকরাইল মসজিদের মাধ্যমে একটি মাদ্রাসাও পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রদের থাকাণ্ডখাওয়া ও পড়ালেখার যাবতীয় খরচ মসজিদের মুরুব্বিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ছাত্রদের পড়ালেখার ব্যাপারে নিয়োজিত শিক্ষকগণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কায়দা থেকে মেশকাত শরিফ পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা রয়েছে। মাদ্রাসায় একশত বিদেশি ছাত্রসহ মোট তিন শতাধিক ছাত্র রয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য হাদিস, কোরআন ও তাফসিরের কিতাব সরবরাহের জন্য মসজিদের একটি লাইব্রেরি রয়েছে।

১৯৪৬ সালে মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেব কলকাতা থেকে বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ নিয়ে আসেন। শুরু থেকে কাকরাইল মসজিদে তাবলিগের কাজ পরিচালনার জন্য রয়েছে ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেব, মাওলানা মুনির আহমদ শাহ, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম, দাদা ভাই, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মুকিত সাহেব ও মাওলানা আলী আকবর সাহেব এবং বর্তমান কমিটিতে রয়েছে ১৫ জন শুরা সদস্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত