
২০২৪ সালের জুলাইয়ে সারাদেশে কোটা বাতিলের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার চলমান আন্দোলনে সারা দেশের ন্যায় ফেনীতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছাত্র-জনতা। এ আন্দোলনে যোগ দিতে ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের উত্তর ফাজিলপুর (কলাতলী) গ্রামের লকিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগর বাড়ির রফিকুল ইসলামের দ্বিতীয় ছেলে সাইদুল ইসলাম শাহী (২১)। নিজের পকেটে টাকা না থাকায় মায়ের কাছ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া নিয়ে গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচীতে অংশ নিতে আসে। অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে গুলি চালায় এতে তার পিঠে ৩টি ও কানের নিচে একটি গুলিবিদ্ধ হয়। এতে ঝাঁঝরা হয় যায় সাইদুলের শরীর। ফেনীর মহিপাল সার্কিট হাউজ রোডে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ, স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন সাইদুল ইসলাম শাহী (২১)।
সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া নিয়ে ফেনীতে আসে সে। তার মা রেহানা আক্তার একজন গৃহিনী। আসার সময় মাকে বলেন, এবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হলে আর কখনোই হবে না, প্রয়োজনে মা তোমাকেও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের সাহসিকতার কথা বলছিলেন সাইদুলের মা রেহানা বেগম।
ছেলের জন্য গর্ব হয় উল্লেখ করে রেহানা বেগম বলেন, আন্দোলন শুরুর পর থেকেই সে প্রতিদিন ফেনী গিয়ে অংশগ্রহণ করত। আমাকে বলেই যেত। আমিও যেতে না করিনি কোনদিন। তবে আমার অভাবের সংসার, তার বাবা লেগুনা গাড়ি চালায়। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হওয়াতে তাকে ঠিকভাবে টাকা দিতে পারিনি কোনোদিন। ৪ আগস্ট ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল সাইদুল। বলছিল তার কাছে ২৫ টাকা আছে, আরও ২৫ টাকা হলে ফেনী গিয়ে ফিরে আসতে পারবে।
তিনি বলেন, আমার তিন ছেলে। সাইদুল দ্বিতীয়। ধারদেনা করে তাদের পড়াশোনা করিয়েছি। অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তা পূরণ হতে দেয়নি। আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলল। আমি এ হত্যার বিচার চাই।
সাইদুলের পিতা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাব। কিন্তু আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে, আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গাড়ি চালিয়ে আমি সংসার চালাতাম, বড় ছেলে মাত্র কাজ শুরু করেছিল। আমার ৩ সন্তানের মধ্যে সে বেশি মেধাবী ছিল। তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলল, মামলা করেছি এরইমধ্যে। আমি খুনিদের বিচার চাই।
নিহত সাইদুলের বড় ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই ছিল আমাদের সবার থেকে আলদা। কথাবার্তা কম বলত, মনের মধ্যে দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। রাজনৈতিকভাবে সে কখনও সম্পৃক্ত ছিল না। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তবে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাকে ৪টি গুলি করে মেরে ফেলল। সাইদুলের মৃত্যুর ঘটনার বর্ননা দিয়ে তিনি বলেন, সার্কিট হাউজ রোডে আমার ভাইয়ের লাশ পড়েছিল। পরে আন্দোলনে কিছু শিক্ষার্থী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু পথেই সাইদুল মারা যায়।
পরিবারের বিভিন্ন কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি সামান্য একটা চাকরি করি। মা অসুস্থ, প্রতিদিন ছেলের জন্য কান্না করে। তবে এটি আমাদের গর্বের বিষয়। আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ভাই হারিয়েছি খারাপ লাগছে তবে ভাই হারানোর পর দোয়া করেছি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা যেন এক মিনিটও আর না থাকে। আল্লাহর রহমতে ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তার পতনের সংবাদ পেয়েছি। তখন মানসিক প্রশান্তি পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, ভাই মারা যাওয়ার পর ছাত্ররা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই খোঁজখবর নিয়েছে।
সাইদুলের বাল্যকালের বন্ধু নিশাদুল ইসলাম সৌরভ বলেন, তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল ৪ আগস্ট সকালে। সে বলেন, দেশের প্রতি সাইদুলের অনেক ভালোবাসা ছিল। দেশের নানা অন্যায় দুর্নীতি নিয়ে সে সবসময় সরব ছিল। খেলাধুলায় ছিল তার প্রবল আগ্রহ। চট্টগ্রামে বিভাগীয় পর্যায়েও সে ফুটবল খেলেছে। তার স্বপ্ন ছিল তার পরিবারের অভাব অনটন দূর করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা।
সাইদুলের প্রতিবেশীরা জানান, সাইদুল তাদের জন্য গর্ব। তার বাবার আর্থিক অবস্থা এত ভালো নয়। সে লেখাপড়া করছিল যাতে পরিবারের হাল ধরতে পারে। কিন্তু তার আগেই ঘাতকরা তাকে হত্যা করেছে।
প্রসঙ্গত, বাবা-মায়ের ৩ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সাইদুল। ২০২৩ সালে চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল তার। তবে অভাবের তাড়নায় ওইসময় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি সে। এরপর ২০২৪ সালে তার পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও ২০২১ সালে নিজ ইউনিয়নের ফাজিলপুর ডব্লিউ-বি কাদরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন সাইদুল।