সাম্প্রতিককালে আমাদের কিছু সংখ্যক প্রবীণ মোবাইল ফোনে দীর্ঘ সময় ধরে থাকেন বলে মনে হয়েছে। আমার আশি বছর বয়সী মা ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। মা বহুদিন ধরে বাটন ফোনের পরিবর্তে অ্যান্ড্রয়েড ফোন দাবি করছিলেন। আমরা ভাবছিলাম তিনি টাচ মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন না। আমাদের ধারণা সত্যি হয়নি। মা ইউটিউবে ওয়াজ শুনেন, খবর দেখেন, ভিডিও কলে কথা বলেন, ফেসবুকে আমার পোস্ট দেখে পছন্দ না হলে বকেন। মোবাইল ফোন এখন তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। মোবাইল হাতের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনি, আত্মীয় স্বজন সবাই যার যার মতো করে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রবীণদের জন্য আমাদের সময় বের করা কিছুটা কঠিন বৈকি! প্রবীণদের বড় একটি অংশ মোবাইল ফোনকে নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে। যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে মাঝেমধ্যে পরিবারের কম বয়সীদের সাহায্য নিতে হয়। প্রবীণরা নতুন কিছু গ্রহণ করতে চায় না কিংবা ইতস্তত করে বলে আমরা এতদিন যেটা ভেবেছিলাম তা প্রবীণরা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম; কিন্তু প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে খানিকটা সময় নেয়।
প্রবীণরা অনেক সময়, ইউটিউব, ফেসবুক থেকে অপতথ্য গ্রহণ কিংবা শেয়ার করে ঝামেলা তৈরি করেন। অসত্য, আংশিক সত্য, অর্ধ সত্য সংবাদ প্রবীণদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। দুঃসংবাদ শোনার জন্য মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। দুর্ঘটনা, দুর্যোগ, মারামারি, খুনখারাবি, ধর্ষণের ঘটনা, পরকীয়া, চুরি ডাকাতির সংবাদ শোনার জন্য মানুষের কান খাঁড়া হয়ে যায়। নেতিবাচক সংবাদ প্রবীণ জীবনে ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। প্রবীণরা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকবে আনন্দ লাভের আশায়। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা চেষ্টা প্রবীণদের মস্তিষ্ককে অধিক সক্রিয় করে তোলে। সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক দিকগুলো পরিহার করে ইতিবাচক বিষয়ে অধিক মনোযোগী হলে লাভ বেশি।
প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পোস্ট দেন কিংবা এমন পোস্টে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। কখনো কখনো বিরূপ মন্তব্য প্রবীণকে মর্মাহত করে দেয়। পৃথিবীর প্রায় সব বিষয়ে মতবেদ রয়েছে। যেটা একদল মানে তো আরেক দল মানে না। প্রবীণ দের উচিত হবে, যতটা সম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে চলা। বিতর্ক, সমালোচনা বিরূপ মন্তব্য প্রবীণের মনকে পীড়িত করে। প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ ফেসবুকে ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দুর্দশা প্রকাশ করেন কিংবা আকার ইঙ্গিতে অন্যের প্রতি রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে ব্যক্তি কিছুটা স্বস্তি হয়তো পায়; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিছু সংখ্যক প্রবীণ ফেসবুকে অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের ছবি দিয়ে থাকেন। অজানা-অচেনা অনেককে বন্ধু হিসেবে যুক্ত করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ম্যাসেঞ্জারে এসে প্রেম নিবেদন করে। ম্যানেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করেন, যৌনরসাত্মক, আপত্তিকর, যৌন হয়রানিমূলক কথা বার্তা আদান প্রদান করে ফেঁসে যান। প্রবীণ নারীদের কেউ কেউ মেসেজ দিলে, কল করলে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। অনেকের সাধারণ কান্ডজ্ঞান পর্যন্ত থাকে না।
প্রবীণদের কেউ কেউ সত্যিকারের প্রেমে পড়ে যান। টাকা-পয়সা ধার দেন। নতুন করে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে ঝামেলা বাড়িয়ে তোলেন। ভালোবাসাহীন নিঃসঙ্গ প্রবীণরা আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন সব ঘটনার সাথে যুক্ত হন, যে পরবর্তী সময়ে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা লজ্জায় পড়েন।
প্রবীণরা নিয়ম করে পাঁচবেলা শুভ সকাল, শুভ দুপুর, শুভ বিকেল, শুভ সন্ধ্যা, শুভ রাত্রি লিখে ম্যাসেজ দিতে থাকেন। ম্যাসেঞ্জারে এসব ম্যাসেজ অন্যের বিরক্তি তৈরি করে কি না তা আমরা ভেবে দেখতে চাই না। ফেসবুকে ঘনিষ্ঠ হওয়া দোষের কিছু না; কিন্তু অন্য কিছুর আশায় ফেসবুকে ঘনিষ্ঠ হওয়া অপরাধের সামিল। অন্য কিছুর আশায় যারা দীর্ঘ সময়ে ধরে ফেসবুকে থাকে তারা হয় নির্বোধ নয় তো দুষ্টু প্রকৃতির।
আমরা নারী-পুরুষের সম্পর্ককে যৌনতার বাইরে এনে সম্মান মর্যাদার স্তরে উন্নীত করতে পারিনি। নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকজন কবি সাহিত্যিকের বচনকে আমরা অমৃত বাণী হিসেবে গ্রহণ করে আছি। প্রবীণ বয়সে নারী-পুরুষ যৌনতার বাইরে আবেগিক, মধুর বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। শারীরিকভাবে অক্ষম কেউ কেউ আজেবাজে কথা বলে যৌন উত্তাপ প্রশমনের চেষ্টা করে। মাঝেমধ্যে প্রবীণরা ফেসবুকে আদিরসাত্মক কৌতুক পোস্ট করে এবং পড়ে দারুণ সুখ লাভ করে। এসব কৌতুক অন্যদের শেয়ার করে এবং ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানতে চান।
কমবয়সী কিছু তরুণ অধিক বয়সী নারীদের টার্গেট করে ফেসবুকে নানান ধরনের ফাঁদ পাতে। নিঃসঙ্গ একাকী প্রবীণ নারী অনেক সময় এসব তরুণের ফাঁদে পড়ে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিসহ মানসিক পীড়নের শিকার হন। কিছু সংখ্যক তরুণী ফেসবুকে প্রবীণ পুরুষকে নানান ধরনের প্রলোভনে ফেলে নাজেহাল করেন। বিকাশে টাকা পাঠানোর আবদার থেকে শুরু করে নানান রকমের তদবির শুরু করেন। কোন কোন প্রবীণ ভিডিও কলে কথা বলে নানান ঝামেলায় মানসম্মান নিয়ে টানাটানিতে পড়েন।
ফেসবুকে থাকা প্রবীণদের সতর্ক হতে হবে। ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার না হওয়াই কাম্য। তারপরও কাউকে ভালো লাগলে, ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ থাকলে, প্রেমে পড়লে দোষের কিছু না বরং অনেক বেশি ভালো। ফেসবুক মানে প্রেম-পিরিতের খোলা ময়দান না যে, যখন যাকে মন চায় তাকেই প্রেম নিবেদন করবেন। ফেসবুকে বুদ্ধি বিবেচনা করে থাকলে আনন্দ পাবেন। আবেগে ভাসলে মানসম্মান হারাবেন। ফেসবুক জ্ঞান, তথ্য, বিনোদন, আনন্দ লাভের একটি স্থান। এখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দেয়াই উত্তম।
লেখক : কলামিস্ট