ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সিন্ধু চুক্তি ভেঙে পানি যুদ্ধের মূর্খতা

এমএ হোসাইন
সিন্ধু চুক্তি ভেঙে পানি যুদ্ধের মূর্খতা

ইতিহাস এক অক্লান্ত শিক্ষক, যদিও সবসময় সে অনুগত হয় না। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ কেবল বৈরিতাকে আরও জোরদার করেছে, দারিদ্র্যকে গভীরতর করেছে এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করেছে। আজ, যখন সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে আবারও উত্তেজনা বাড়ছে, তখন একটি বাস্তবতাসম্মত কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদকে- শান্তি কোনো কল্পনাপ্রসূত বিলাসিতা নয়, বরং তা বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত। ২২শে এপ্রিল পাহেলগাম ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট ছিল একটি নৃশংস এবং নিন্দনীয় কাজ।

এতে কাশ্মীরে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটককে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, যা এই অঞ্চলের অব্যাহত অস্থিরতার নির্মম স্মারক। ক্ষুব্ধ ভারতীয় জনগণ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে, ভারতীয় সরকার ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ স্থগিত করে। এটি এমন একটি চুক্তি, যা একসময় দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বিরল কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। প্রত্যাশিতভাবেই, পাকিস্তান সতর্ক করে দেয় যে, জলপ্রবাহ বন্ধের যে কোনো প্রচেষ্টা ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ হিসেবে গণ্য হবে এবং তার পূর্ণ শক্তিতে জবাব দেওয়া হবে।

সহজেই বোঝা যায় কেন উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট তৈরি হলো, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেখানে নেতারা জনতার ক্ষোভের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কিন্তু ইতিহাস, ভূ-রাজনীতি এবং মৌলিক বিবেচনা- সবই এক ভিন্ন পথের দাবি করে। কঠোর বাস্তবনীতির বিচারে, কোনো পক্ষই পানিকে অস্ত্ররূপে ব্যবহারের ঝুঁকি নিতে পারে না। যে বিপজ্জনক পথে তারা এখন হাঁটার প্রলোভনে পড়েছে, সেটি বিজয়ের দিকে নয়, বরং উভয়ের দারিদ্র্যের দিকেই নিয়ে যাবে।

সিন্ধু জলচুক্তি- যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কয়েক দশকের তিক্ত অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়েও টিকে আছে। দীর্ঘ কঠিন আলোচনার পর ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদী দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়েছিল। ভারতের নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়েছিল পূর্বের তিনটি উপনদী- রাভি, বেয়াস এবং শতদ্রু; আর পাকিস্তানের হাতে ছিল পশ্চিমের তিনটি নদী- সিন্ধু নদ, ঝেলম এবং চেনাব। গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারতকে পশ্চিমের নদীগুলো ব্যবহার করার সীমিত অধিকার দেওয়া হলেও, কোনোভাবেই এমন কোনো কতৃত্বমূলক ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়নি যা পাকিস্তানের পানির প্রবাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেবে।

চুক্তিটি ৬৫ বছর ধরে টিকে আছে কোনো কাকতালীয় কারণে নয়।

বরং এটি প্রমাণ করে যে, ভারত বা পাকিস্তান কেউই এমন এক নদী ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করার পরিণাম বহন করতে সক্ষম নয়, যা কোটি কোটি মানুষের জীবনধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য, যার সেচনির্ভর কৃষির ৮০ শতাংশ এই পানির ওপর নির্ভরশীল। এই পানির প্রবাহের সঙ্গে কোনো অবিবেচনাপ্রসূত স্বীদ্ধান্তের কারণে অনাহার, বাস্তুচ্যুতি এবং সম্ভবত একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের পতনের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির মাত্রা কম নয়: আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং পরমাণু শক্তিধর প্রতিপক্ষের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের অদূর ভবিষ্যতের আশঙ্কা।

প্রযুক্তিগতভাবে, উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেন যে, বর্তমানে ভারত পশ্চিম দিকের নদীগুলোর জলপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ করার মতো অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে এরূপ কোনো বিশাল জলাধার বা খাল নির্মাণ, যা সিন্ধু ও তার উপনদীর জল সরিয়ে দিতে পারে, তা করতে কয়েক সপ্তাহ নয়, কয়েক বছর লাগবে। এমনকি যদি এই ধরনের প্রকল্প শুরুও হয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক খরচ হবে বিপুল।

তবে, ক্ষণিক প্রকৌশলগত সাফল্যের চেয়ে বড় বিপদ হলো উত্তেজনার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব। ভারতের চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত স্বল্পমেয়াদে প্রতীকী হলেও, এটি এমন এক নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা এতদিন জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে খারাপ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। পাশাপাশি এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা ভবিষ্যতে ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হতে পারে। মনে রাখতে হবে, চীনের অধীনে আছে ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎসস্থল, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভারত আন্তর্জাতিক নদীচুক্তিকে চাপের মুখে বাতিলযোগ্য বলে ধরে নেয়, তবে অন্যদের কাছ থেকেও অনুরূপ আচরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে। দেশটির নেতারা ঘোষণা করেছেন, সিন্ধুর জলপ্রবাহে বাধা দিলে তা যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হবে এবং পূর্ণ শক্তিতে জবাব দেওয়া হবে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অবিবেচনাপ্রসূত মনোভাব। জলপ্রবাহকে অস্তিত্বের প্রশ্নে রূপান্তরিত করে, ইসলামাবাদ নিজেকে এমন এক কঠিন অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কূটনৈতিক পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। উভয় পক্ষের উচিত তাদের বিচক্ষণ কণ্ঠস্বরগুলোর একমত হয়ে স্বীকার করা যে, নদীগুলোর উপর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কোনো দুর্বলতা নয় বরং এটি টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।

নিশ্চয়ই, চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যা উপেক্ষা করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তন হিমালয় অঞ্চলের আবহাওয়ার ধরন দ্রুত পরিবর্তন করছে। হিমবাহগুলো অস্বাভাবিক হারে গলছে। বর্ষা ঋতু ক্রমবর্ধমান ভাবে অনিয়মিত হচ্ছে এবং বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাহিদা পানিসম্পদের উপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করছে। ভারত ও পাকিস্তান- উভয় দেশেরই এমন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া দরকার, যেখানে বর্তমান পানিবণ্টন ব্যবস্থার উপর ক্রমাগত চাপ পড়বে। তবে এই প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সংঘাত নয়।

বর্তমান সংকট উভয় দেশের জন্য এক নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। চিরন্তন শত্রুতার বদলে ব্যবহারিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠনের। ৬৫ বছরের পুরোনো কাঠামো ধ্বংস না করে, ভারত ও পাকিস্তানের উচিত সেটিকে আরও শক্তিশালী করা। বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতি আধুনিকীকরণ করা, তথ্য বিনিময় বৃদ্ধি করা, এবং বন্যা বা খরার মতো জরুরি পরিস্থিতিতে যৌথ প্রটোকল তৈরি করা। এই ধরনের উদ্যোগ ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি কমাবে এবং নিজেদের জনগণ ও বিশ্বের কাছে প্রমাণ করবে যে, তারা দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘রক্ত ও পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।’ এটি শক্তিশালী একটি উক্তি, কিন্তু প্রজ্ঞার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। রক্তপাত এরইমধ্যে ঘটেছে; পানিকে অস্ত্র বানিয়ে আরও মৃত্যু এনে দেওয়া সেই বেদনার পূরণ নয়, বরং নতুন ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করবে। প্রকৃত সম্মান হবে, কঠিন হলেও, শান্তির প্রতি অবিচল অঙ্গীকার বজায় রাখা।

পাকিস্তানের জন্যও একটি বিকল্প পথ রয়েছে। ভারতের প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখার পরিবর্তে, উন্নত পানিব্যবস্থাপনা, কৃষিতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং এমন কূটনৈতিক উদ্যোগে বিনিয়োগ করা উচিত, যা বৈধ উদ্বেগসমূহ সমাধান করবে কিন্তু প্রতিটি বিরোধকে যুদ্ধের ইস্যুতে পরিণত করবে না।

শেষ পর্যন্ত, সিন্ধু কোনো রাজনীতিক বা সেনাপ্রধানের সম্পত্তি নয়। এটি পাঞ্জাবের কৃষক, সিন্ধু অববাহিকার পরিবারগুলো, করাচির জেলেরা এবং কাশ্মীরের নদী-তীরবর্তী সম্প্রদায়ের, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর পাশে বাস করে আসছে। তাদের ভবিষ্যৎকে সেইসব বিপজ্জনক বাস্তবতা বিবর্জিত ভাবনার বলি হতে দেয়া উচিত নয়, যারা সংঘাতকে সাহসীকতা বলে ভুল করে।

এই ক্রমবর্ধমান সংকটাপন্ন এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে, পানি ভাগাভাগি করা কোনো দুর্বলতা নয় বরং এটি সম্মিলিতভাবে টিকে থাকার লড়াই। নদীকে অস্ত্রে পরিণত করে কোনো গৌরব নেই, আছে কেবল ধ্বংস।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত