ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আনন্দযাত্রাকে বিষাদে রূপ দেয় রোডক্র্যাশ

তরিকুল ইসলাম
আনন্দযাত্রাকে বিষাদে রূপ দেয় রোডক্র্যাশ

সড়কে রোজ ঝরছে প্রাণ। ঈদের আনন্দ বিষাদে রূপ নিচ্ছে। অন্যান্য সপ্তাহের তুলনায় ঈদের সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনার (রোডক্র্যাশ) সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে হাসিমাখা মুখ প্রিয়জনের হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে বাড়ির উঠানে আসছে নিথর দেহ। আমাদের দেশের সড়কগুলো যেন হয়ে উঠছে একেকটি মৃত্যু ফাঁদ। প্রতিনিয়ত রোডক্র্যাশের খবর আমরা পাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে আহত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় রোডক্র্যাশে; আহত হন ৩ লাখের বেশি। এই প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে দরকার ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর তথ্যানুযায়ী গেল ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ৮ দিনে ১১০টি রোডক্র্যাশে ১৩২ জন নিহত ও ২০৮ জন আহত হয়। অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৫ দিনে ৩১৫টি রোডক্র্যাশে ৩২২ জন নিহত ও ৮২৬ জন আহত হয়। এবং রোড সেফটি ফউন্ডেশেন বলছে ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১১ দিনে ২৫৭ টি রোডক্র্যাশে ২৪৯ জন নিহত ও ৫৫৩ জন আহত হয়। এসব মৃত্যু আমরা প্রত্যাশা করিনা। আমরা চাই এই মরণঘাতি রোডক্র্যাশ রোধ হোক। সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ওই বিধিমালায় গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশু আসন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়নি। বেপরোয়া গতি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা, সাইকেল-রিকশা-মোটরগাড়ি একই সঙ্গে চলাচল করার ফলে রোডক্র্যাশ নেমে আসছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও চালকরা তার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিবছর ঈদ পূর্ব যাতায়াতকালে রোডক্র্যাশে মানুষ মারা যাচ্ছে।

এবারের ঈদে রোডক্র্যাশের অন্যতম কারণ হলো- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, মদ্যপ অবস্থায় যানবাহন চালানো, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা অবাধে চলাচল, বেপরোয়া যানবাহন চালানো, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা। সড়কপথে যাতায়াত নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে রোডক্র্যাশে শত শত মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ দ্রুত নেয়া দরকার তা হলো-অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্পিডগান ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, প্যাডেলচালিত রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোডক্র্যাশ এড়িয়ে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হলে মোটরসাইকেল চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে এখন সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের কারণে। তাছাড়া ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্টদের নজরদারি জোরদার করতে হবে। তবে শুধুমাত্র চালকের বেপরোয়া গতিই রোডক্র্যাশের একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ ড্রাইভার, ভুয়া লাইসেন্স, অতিরিক্ত পণ্যসামগ্রী বা যাত্রী পরিবহন, চালকের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতার অভাব, চলন্ত বাস, ট্রাকে, মুঠোফোন ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে রোডক্র্যাশ ঘটে। আবার অনেক সময় দেখা যায় খারাপ রাস্তায়ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও ওভারটেক করার হীনমানসিকতাও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী । ৯০ শতাংশ রোডক্র্যাশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। রোডক্র্যাশরোধে আইনের প্রয়োগ অত্যান্ত জরুরি। তাই অতিদ্রুত একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ এখন সময়ের দাবি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং জাতিসংঘের গ্লোবাল প্ল্যানের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রোডক্র্যাশে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশ, মৃত্যু ও আহত হওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। এজন্য দরকার উপযুক্ত শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সড়কে মৃত্যু ও আহত কমাতে প্রয়োজন শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে হোক নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি-২০২৩ এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে প্রায় ৮৭ জনের। বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়কে মানুষের জীবন বাঁচাতে নিতে চাই কার্যকর উদ্যোগ। আমার প্রত্যাশা কোনো আনন্দযাত্রা যেন বিষাদে রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে জনসচেতনতাই পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আপনজন হারানোর বেদনা শুধু স্বজনরাই অনুভব করছেন বারবার। কে, কখন, কোথায়, কীভাবে রোডক্র্যাশের সম্মুখীন হবেন তা কেউ জানে না।

বাস্তবিক অর্থেই এটা এখন মহামারির রূপ নিয়েছে। এর হ্রাশ টেনে ধরতেই হবে, থামাতে হবে শবযাত্রার মিছিল। তবেই হয়তো উৎসবে নাড়ির টানে যাত্রা আর ফিরতিকালে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়বে না কেউ, বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সময় লাশ হয়ে ফিরবে না! রোডক্র্যাশে এই মৃত্যুর মিছিল সামাল দিতে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা জনগণ ভীষণভাবে অনুভব করছে। রোডক্র্যাশ নিয়ন্ত্রণে আসুক, প্রতিটি উৎসব হোক নিরাপদ, উৎকণ্ঠাহীন, বর্ণিল ও আনন্দময়।

অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত