ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস

শব্দদূষণের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো রোধ করতে প্রয়োজন জনসচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শব্দদূষণের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো রোধ করতে প্রয়োজন জনসচেতনতা

আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস ২০২৫। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর হেয়ারিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন ১৯৯৬ সাল থেকে উচ্চ শব্দ নিয়ে বৈশ্বিক প্রচারণা শুরু করে। ১৯৯৬ সাল থেকে এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সে অনুযায়ী এবার ৩০ এপ্রিল হচ্ছে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস। শব্দদূষণ, শব্দ দূষণের ক্ষতিকারক দিকসমূহ, শব্দ দূষণরোধে করণীয় সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরা এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। শব্দদূষণ এক ধরনের পরিবেশ দূষণ। এক নীরব ঘাতক। আর পরিবেশদূষণ আমাদের সঠিক অনুধাবনের অভাবে দিন দিন এই দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অনেক পরিবেশবাদী বাংলাদেশের শব্দদূষণের বর্তমান পর্যায়কে ‘শব্দণ্ডসন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করেছেন। ‘শব্দণ্ডসন্ত্রাস’ আমাদের মাথাব্যথার কারণ। বর্তমানে ঢাকা শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। সেটা সমস্যা মনে হলেও আমাদের অসচেতনতার কারণে আমরা প্রায়ই বলে থাকি এটার নিরসন সম্ভব নয়। কিন্তু এ সমস্যাগুলো মানুষেরই তৈরি। আমরা একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানুষের তৈরি এমন একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা হলো শব্দদূষণ। বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে এমনকি বিনোদনের সময়ও আমরা বিভিন্নভাবে শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছি। বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বাংলাদেশেও বর্তমানে পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়টি একটি আলোচিত বিষয়। অনেক ব্যক্তি বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি তথা পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে। প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে আরও এগিয়ে আসতে হবে। অতি সম্প্রতি পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা জনস্বার্থ তথা পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ। যা সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যমগুলো এগিয়ে এসে তা কার্যকর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণ-পানিদূষণ রোধ এবং বনায়নের বিষয়গুলো আলোচিত হলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনার গণ্ডি একেবারেই সীমিত। শব্দদূষণের কারণেও মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে তেমন কোনো আইন নেই, ট্রাফিক আইনও যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশে শব্দ দূষণের কারণে অনেক মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে উঠে আসে সাম্প্রতিক এক জরিপে। আর বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কি ধরনের শব্দদূষণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে।

শব্দের মাত্রা যেমন হতে হবে: বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে।

দিনে রাতে নির্মাণকাজ : ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় দিন নেই রাত নেই পাইলিংয়ের কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সময় সম্পর্কে কোনো বালাই নেই।

বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে বলা আছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের এসব যন্ত্র চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলে কিছু আসলে নেই। অন্তত বড় শহরগুলোতে অভিজ্ঞতা হলো মধ্যরাত এমনকি সারা রাত জুড়ে নির্মাণকাজ চলে। কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কি না, শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোনো কিছুই অসময়ে নির্মাণকাজ থামাতে পারে না। আবদ্ধ কোনো স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ভবনে কোনো ধরনের নতুন কাজ, ড্রিল মেশিনের, অফিসের ডেকোরেশনে নিয়মিতই ভঙ্গ হচ্ছে এই নিয়ম।

মাইক ও লাউড স্পিকারের ব্যবহার : বাংলাদেশে মাইকের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়। বেশ কিছুদিন ধরে লাউড স্পিকারও ব্যবহার হচ্ছে। রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পিকনিক সব ক্ষেত্রে এর কানফাটানো শব্দ চলে। তবে আইনে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতিও রয়েছে। খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা অতিক্রম করে- এমন যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় এই শব্দ করা যাবে না এবং রাত ১০টার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। পিকনিকের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে মাইক ও লাউড স্পিকার ব্যবহার করা যাবে। তবে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এছাড়া ফেরার পথে এগুলো বাজানো যাবে না। আর পিকনিক আয়োজন করতে হবে আবাসিক এলাকা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে।

হর্ন বাজানো : হর্ন বাজানো সম্ভবত বাংলাদেশে গাড়ি চালকদের বড় বদভ্যাস। ট্রাফিক সিগনাল ও জ্যামে আটকে থাকার সময় সামনে এগুনো যাবে না জেনেও হর্ন বাজান তারা। সামনে কেউ ধীর গতিতে চললে, পথচারীকে উদ্দেশ্য করে প্রতিনিয়ত হর্ন বাজানো হয়।

যদিও বিধিমালায় বলা আছে কোনো ধরনের মোটরযানে শব্দের মান অতিক্রমকারী হর্ন ব্যবহার করা যাবে না। নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ির হর্নে রীতিমতো বধিরতার হার বেড়ে গেছে ঢাকায়। প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা অন্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাজধানীসহ অন্য শহরগুলোতে প্রতিনিয়তই মোটরচালিত যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের মাধ্যমে শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন নিরপরাধ জনগণ। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ কানে কম শোনা থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বধির হচ্ছে। এই সমস্যায় ভোগা মানুষ সবচেয়ে বেশি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে। ঢাকার কাছের এই বিভাগের ৫৫ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের শিকার। সিলেটে প্রায় ৩১ শতাংশ, ঢাকায় ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, রাজশাহীতে প্রায় ১৪ শতাংশ রাজপথে কর্মরত পেশাজীবী শব্দদূষণে ভুগছেন।

ঢাকাসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ৪২ ভাগ রিকশাচলকই এই শব্দদূষণের শিকার। এছাড়া প্রায় ৩১ ট্রাফিক পুলিশ, ২৪ শতাংশ সিএনজি চালক, ২৪ শতাংশ দোকানদার, ১৬ শতাংশ বাস, ১৫ শতাংশ প্রাইভেট কার এবং ১৩ শতাংশ মোটরসাইকেল। এসব সমস্যায় ভোগাদের ৭ শতাংশের শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র (কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট) ব্যবহার জরুরি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইয়েন্সের ‘বাংলাদেশের রাজপথে শব্দদূষণ এবং শব্দদূষণের কারণে রাজপথে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণ সমস্যা’ নিয়ে করা অতিসম্প্রতি এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের ৫৬ দশমিক ৪ ভাগ পুলিশ কানে কম শোনেন, এর মধ্যে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে হারানোর পথে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। গবেষণা তথ্য প্রকাশ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দদূষণের মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবলের কথা উল্লেখ করা থাকলেও কিন্তু ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের কানের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ গুণের বেশি শব্দ শোনা যায়। এতে করে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেটি শব্দদূষণে আক্রান্ত হয় না। তবে শব্দদূষণে তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয় মানুষের কান। কানের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। উচ্চ শব্দে মানুষ যদি বেশি সময় ধরে থাকে, সে সাময়িকভাবে বধির হয়ে যেতে পারে। হাইড্রোলিক হর্নের কারণে শব্দদূষণের মানমাত্রা ১২০ থেকে ১৩০ পর্যন্ত উঠে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো মানুষকে যদি ১০০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে ১৫ মিনিটের বেশি সময় থাকলে তার শ্রবণক্ষমতা একেবারে হারিয়ে যেতে পারে। একজন মানুষকে যদি আট ঘণ্টা করে ক্রমাগত ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল শব্দের মাঝখানে রেখে দেওয়া যায়, এক বছরের মাথায় লোকটি বধির হয়ে যাবেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর মানুষ বর্তমানে অতিমাত্রায় শব্দদূষণে আক্রান্ত। রাজধানী শহর ঢাকার এমন কোনো নাগরিক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে শব্দদূষণের শিকার হয়নি। শিশু, নারী-বৃদ্ধরা এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ আজ শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে নানা রকম জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, ফলে বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারা মতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১৩৯ এবং ১৪০নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫০ ডেসিবল নির্ধারিত হয়েছে।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’ হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদণ্ড১৮ বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের কথা বলা হলেও সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ এবং ৩২ এই দুটি অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকার বলতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকারকে অন্তর্ভুক্তি করা হয়। ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য মামলার [৪৮ ডিএলআর (১৯৯৬) পৃষ্ঠা. ৪৩৮ এবং ১৭ বিএলডি (১৯৯৬) (এডি) পৃষ্ঠা. ১] রায়ে বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার হিসেবে জীবন ধারণের অধিকার বলতে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এছাড়া ইন্ডিয়ান সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বাঁচাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং ইন্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্ট ফোরাম ফর প্রিভেনশন অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাউন্ড পলিউশন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া {১ এআইআর (২০০৫) (এসসি) ৩১৩৬} মামলায় লাউড স্পিকারের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দদূষণকে সংবিধানে প্রদত্ত মত প্রকাশের অধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে।

শব্দদূষণ প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। শব্দদূষণ রোধ করার জন্য সরকার হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এরপরও শব্দদূষণ কমছে না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ এ আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে, ফলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শব্দদূষণ রোধ করা অতীব জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি। এজন্য সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শব্দদূষণের অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু গাড়ির হর্ন কমানো গেলেই শব্দদূষণের পরিমাণ ৮০ ভাগ কমে যাবে। এই মারাত্মক ঘাতক থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকম-লী ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

শাস্তির যেসব বিধান রয়েছে : আইন ভঙ্গ করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শব্দের উৎস যন্ত্রপাতি জব্দ করতে পারবেন। বিধিমালায় যেসব উল্লেখ করা রয়েছে তা পালনে ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে ধরা হবে।

শব্দ দূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য একমাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের দণ্ডই প্রদান করার বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। আপনি শব্দ দূষণের শিকার এমন মনে হলে টেলিফোনে, লিখিত অথবা মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন।

হর্নের শব্দে স্বাস্থ্য সমস্যা : শব্দ দূষণ শরীরের যেসব ক্ষতি করে লম্বা সময় অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কান। অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘদিন কাটালে শ্রবণ শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এমনকি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

এর ফলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণ শক্তি হারাতে থাকে। কত ডেসিবল শব্দে আপনি কতটুকু সময় কাটাচ্ছেন তার উপর বিষয়টি নির্ভর করে। ১২০ ডেসিবেল শব্দ সঙ্গেই সঙ্গে কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে। মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০’র উপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। বছর কয়েক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের করা এক জরিপে উঠে এসেছে যে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে এরইমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রতি ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএনইপি। তাতে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল এবং রাজশাহীতে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবল পাওয়া গেছে। বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন বলছে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সবশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত এই মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের তীব্রতা এই নির্ধারিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।

শব্দদূষণের প্রধান উৎস

যানবাহনের শব্দ: গাড়ি, বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন এবং হর্ন।

শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ: বড় বড় মেশিন, ড্রিলিং ইত্যাদি।

বিনোদন মাধ্যম: উচ্চ শব্দে গান বাজানো, সিনেমা হল, কনসার্ট।

গৃহস্থালি সামগ্রী: ব্লেন্ডার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, জেনারেটর ইত্যাদি।

সামরিক কার্যক্রম: যুদ্ধবিমান, বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ।

নির্মাণকাজ: রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণের কাজের শব্দ।

শব্দদূষণে মানবদেহে প্রভাব

শ্রবণশক্তি হ্রাস: ক্রমাগত উচ্চ শব্দে থাকা ব্যক্তিদের কানে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।

ঘুমের ব্যাঘাত: শব্দ ঘুমের গুণমান নষ্ট করে, ফলে ক্লান্তি, মেজাজ খারাপ ও কর্মক্ষমতা কমে যায়।

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: অনবরত শব্দ মানুষকে অস্থির ও বিষণ্ণ করে তোলে।

হৃদরোগের ঝুঁকি: গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার শব্দ উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের রোগ বাড়িয়ে দিতে পারে।

শিশুদের বিকাশে বাধা: অতিরিক্ত শব্দ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়

সচেতনতা বৃদ্ধি: বিদ্যালয়, কলেজ, কর্মক্ষেত্রে শব্দদূষণের কুফল সম্পর্কে প্রচার চালানো।

আইন প্রয়োগ: নির্দিষ্ট এলাকায় শব্দমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ।

শব্দশোষক প্রযুক্তি: যানবাহন ও যন্ত্রপাতিতে শব্দ কমানোর প্রযুক্তির ব্যবহার।

সবুজ বেষ্টনী গড়া: গাছপালা শব্দ শোষণে সহায়তা করে, তাই শহরে আরও সবুজায়ন জরুরি।

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা: অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানো এড়িয়ে চলা, উচ্চ শব্দে গান না বাজানো। পরিশেষে বলতে চাই, শব্দ দূষণরোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন হওয়া শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কাজ করতে আগ্রহী, আশা করি তারাও এ প্রতিবেদন থেকে লাভবান হবেন। আমি মনে করি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐক্যবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। এছাড়া হাজারো উপায় রয়েছে যা আমাদের সবুজ পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। এখন শুধু প্রয়োজন পৃথিবীবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আসুন, আমরা মিলেমিশে একটি সজীব সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি, পরবর্তী প্রজন্মকে সুন্দর ভুবন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত