প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
মহান মে দিবস; বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতির দিন। মেহনতি শ্রমিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবছর ১ মে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। ১৮৮৬ সালের এদিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই সময়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি অজ্ঞাতনামা কেউ বোমা নিক্ষেপ করলে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ওইদিন তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্বে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় এই ঘটনার আরও পরে।
১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৮৯৪ সালে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ধারবাহিকতায় ১০০ বছর পর ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার’ সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে সারা বিশ্বে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
২. আজকের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিই হচ্ছে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের নিরলস পরিশ্রম। হাজার বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষের রক্ত-ঘামে যে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তা থেকে সেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীই সব সময় উপক্ষিত থেকেছে। আজকের উন্নত-সমৃদ্ধ পৃথিবীর কারিগর এসব অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এখনও অব্যাহত রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় ‘অধিকার’ শব্দটির সুদৃঢ় শক্তি সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও দর্শনকে প্রভাবিত করেছে এবং পরিবর্তন সাধিত করেছে শ্রমিক শ্রেণির। মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রবণতা পৃথিবীর দেশে দেশে অধিকারবঞ্চিত মেহনতি মানুষের মধ্যে এক নবতর জাগরণ ঘটিয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় গতিশীল হয়েছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রাকে। বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের মানবিক সত্ত্বায়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও মানবিক বিশ্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে শ্রমজীবী মানুষের আত্মনিবেদন আর স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধে সঞ্চারিত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের কথা বলতে গেলেই আজকাল শুধুই পোশাক শিল্পের শ্রমিকের কথা বলা হয়। অথচ এটি সঠিক চিত্র নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা সাত কোটি ৭৬ লাখের বেশি, এর মধ্যে সব ধরনের শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ আছেন। যদি মনে করা হয় ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকের পক্ষে কথা বলার বা শ্রমিকের স্বার্থ দেখার প্রতিষ্ঠান, কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে, সারা দেশে মাত্র ১৬৯টি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সদস্য হচ্ছে ২৩ লাখ; যা মোট শ্রমজীবী মানুষের তিন শতাংশ মাত্র। শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেও বড় পার্থক্য রয়েছে। যারা নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামোতে আছে তাদের মধ্যেও ট্রেড ইউনিয়ন খুব সক্রিয় নয়, মাত্র ২৩ শতাংশের সদস্য আছেন। নারী শ্রমিকদের মাত্র ১৫ শতাংশ ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত আছেন কিন্তু নেতৃত্বে আছেন খুব কম তাই তাদের বিশেষ দাবি উপেক্ষিত হয় বারবার। সরকারি বড় বড় কারখানায়ই ট্রেড ইউনিয়ন বেশি সক্রিয় যেখানে কারখানাই চলে না বা প্রায় সব কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। আর বেসরকারি বড় বড় কোম্পানিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা বা অধিকার স্বীকৃত নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের যে দুরবস্থা তার মূল কারণ হচ্ছে তারা মালিক বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নয় বরং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে একে অপরের বিরোধিতায় লিপ্ত থাকছে। শ্রমিকের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজ দল ও নিজ গোষ্ঠীর স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। অন্যদিকে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি চোখে পড়ে গার্মেন্ট কারখানায় কিন্তু এখানেও প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৬৩ হাজার ইউনিয়ন করার অনুমতি পেয়েছেন, কিন্তু তাও পুরোপুরি ট্রেড ইউনিয়নের নিয়মমতো নয়। আমরা গত শতকের আশির দশকের শুরুতে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপের যে তৎপরতা দেখেছিলাম আজ সেই সংগঠন অনেকটাই সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন শ্রমিক দিবসে কথা বলতে গেলে শুধু দেশের ভেতরে যারা কাজ করছেন তাদের কথা নয়, আমাদের বলতে হবে দেশের বাইরে প্রবাসী শ্রমিকের কথাও। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়ে এই শ্রমিকদের বিদেশে পাঠায় এবং তাদের পাঠানো ডলার-পাউন্ড-রিয়ালে দেশের কোষাগার ভরে যায় তখন যদি কেউ তাদের অধিকারের কথা না বলে কিংবা তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয়, এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।
৪. ঐতিহাসিক মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন। তাদের ন্যায্য পাওনা আদায় তথা অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমিকদের অস্তিত্ব ঘোষণার দিন। মে দিবসের প্রেক্ষাপট একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হলো, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। উনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। তখন দেশে দেশে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। মালিকরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও শ্রমিক তার ন্যায্য মূল্য পেতেন না। মালিকরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং তারা শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা, মানবিক অধিকার ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাস-দাসীর মতো মনে করতেন। আর তাদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই মালিকরা শ্রমিকের ওপর চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন।
প্রতি বছর মে দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত ইতিহাসকে স্মরণ করে তেমনি স্বপ্ন দেখে তাদের অধিকারের ষোলআনা প্রাপ্তির। বাংলাদেশের শ্রমিকরাও নিঃসন্দেহে এর বাইরে নয়। কিন্তু আজও বাংলাদেশের শ্রমিকদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের শ্রমিকদের দিকে তাকালে আমরা আজও দেখতে পাই মালিকশ্রেণি কীভাবে তাদের শোষণ করছে। মালিক শ্রেণির শোষণের ফলে অসহায়ের মতো শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি কিন্তু বাস্তবে মজদুর মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শাসক, প্রশাসক ও মালিকগোষ্ঠী আদৌ আন্তরিক হতে পারিনি। যদিও সময়ের ব্যবধানে শ্রমজীবী মানুষের যান্ত্রিক বিপ্লবের কারণে কাজের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার অদ্যাবধি অধরাই থেকে গেল। পোশাক শিল্পের বিকাশে এই দেশে নারীর শ্রমিকের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু যেই নারী শ্রমিকের অবদানে দেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই নারীশ্রমিকের চলমান জীবনযাপন বড়ই দুর্বিষহ। বেতনের সঙ্গে যাদের জীবনযাত্রার ব্যয় খাপ খায় না তারাই হলেন গার্মেন্টস শ্রমিক। বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে পোশাকশ্রমিকের পর নির্মাণশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাদের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে তারাও তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা অনেক সময় পায় না।