ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শ্রমিকের শ্রম, ঘাম ও সভ্যতার উন্নয়ন

অলোক আচার্য
শ্রমিকের শ্রম, ঘাম ও সভ্যতার উন্নয়ন

‘ঠুলি খুলে দেখ, প্রতিটি ইটে আছে লিখা, তুমি জান নাকো, কিন্তু পথের প্রতিটি ধূলিকণা জানে, ওই পথ, ওই জাহাজ, সড়ক, অট্টালিকার মানে!’- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কুলি-মজুর কবিতার কয়েকটি লাইন থেকেই বোঝা যায় আজ আমরা যে আরামের অট্টালিকায় দিন কাটাই সেসব শ্রমিকের ঘামে গড়া। প্রতিটি ইটে লেগে আছে ঘাম। শ্রম, শ্রমিক এই দুয়ের উপরেই আজকের আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের সুউচ্চ অট্টালিকা শ্রমিকদের ঘামের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে তাজমহলকে নিয়ে আজ বিশ্বের এত মাতামাতি সেই তাজমহল তৈরিতে লেগেছে শ্রমিকদের ঘাম। অথচ আজকের সমাজ যেন কুলি-মজুর এবং সাহেব এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেছে। সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই এই বিভাজন শক্ত হচ্ছে। এই পার্থক্য গড়ছে অর্থ। যার অর্থ আছে সে মালিক। আর যার নেই সেই শ্রমিক! অথচ সবাই কাজ করে, ফলে সবাই শ্রম দেয় অর্থাৎ শ্রমিক। তবু মালিকের ভূমিকায় যারা আছেন তারা এই সহজ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে না আর পারলেও তা স্বীকার করতে চান না। এতে তাদের আরামণ্ডআয়েশের অসুুবিধা হবে। শ্রম ও শ্রমিক শব্দ দুটি একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। শ্রমিকের কাজের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এর মধ্যে কর্মপরিবেশ, ন্যায্য পারিশ্রমিক, কর্মঘণ্টা, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা এবং কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কর্মঘণ্টাকে কেন্দ্র করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বহু জল গড়িয়েছে। শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমেছে। তবে এখনও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। কথায় কথায় ছাঁটাইয়ের শিকার হয়। নারী শ্রমিকের দুর্দশা তো আরও একধাপ এগিয়ে। কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয় অনেকে। তারপর বেতন বৈষম্য তো থাকেই। ১ লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা মে দিবস নামেই বেশি পরিচিত।

এর পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ইতিহাস। যে ইতিহাস আজও সেদিনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নিয়ে অসন্তোষ ছিল বহুদিনের। কম মজুরিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করানো হতো তাদের দিয়ে। এর ফলে তাদের মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো। এই কাজের সময়কাল ছিল ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা। শিল্প মালিকরাই বেশি লাভ ভোগ করত। ফলে শ্রমিকদের জীবন ছিল মানবেতর। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি জানান। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই দাবিতে ১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিকদের আন্দোলন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশসহ ১০-১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা রোগে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয় বলে তথ্যে জানা গেছে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে অর্থনীতি। বছরে বৈশ্বিক জিডিপি হারাতে হচ্ছে ৪ শতাংশ। আইএলওর তথ্যানুসারে, সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতার কারণে বিশ্বে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে অন্তত একজন কর্মী মারা যান। কর্মক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা বৈশ্বিক জিডিপির ৪ শতাংশের সমান।

বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে এক হাজার ৪৩২ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন ৫০২ জন। অনানুষ্ঠানিক খাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক হাজার ১০৩ জনের। সবচেয়ে বেশি ৬৩৭ জন মারা যান পরিবহন খাতে। এছাড়া নির্মাণ খাতে ১৪৯ জন এবং দৈনিক মজুরিভিত্তিক খাতে ২২০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা রোগে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

শ্রম আইন ২০০৬ সালের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে, শ্রমিক হলো ওই ব্যক্তি, যিনি তার চাকরির শর্ত পালন করে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি কাজে নিযুক্ত। এছাড়া ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজে নিয়োজিতদেরও শ্রমিক বলা যাবে। মোট শ্রমিকের মধ্যে ৮৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে। মূলত তারা রিকশাচালক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার, ভাঙারি সংগ্রহকারী, পরিবহন শ্রমিক এবং খণ্ডলীন

গৃহকর্মী প্রভৃতি বাকি ১৩ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে। পেশার দিক থেকে কৃষক, মৎস্যজীবীর সংখ্যাই বেশি। তবে পোশাক শিল্পে বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যাক ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তৈরি পোশাক খাতে মোট লোকবল ৪৩ লাখ ১৬ হাজার জন বলে জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতের ৩৭.৫১ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ লাখ ১৯ হাজার জন নারী শ্রমিক। যদিও গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেজ অনুসারে) অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন। অন্যদিকে নিট (গেঞ্জিজাতীয় পোশাক উৎপাদন) পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী, নিট সেক্টরে ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জনই নারী। সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন।

সভ্যতার আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে শ্রেণি বিভাজন গড়ে ওঠে। নগর সভ্যতা বিকশিত হওয়ার শুরু থেকে এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদল মালিক শ্রেণি এবং অন্যদিকে থাকে শ্রমিক। এক শ্রেণি ভোগবাদিতাকে গ্রহণ করতে থাকে এবং অন্যশ্রেণি তাদের ভোগের রসদ যোগান দিতে ব্যস্ত থাকে। শ্রম দিয়েই সভ্যতার অগ্রযাত্রা আজ অবধি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আজ আমাদের অর্থনীতির এক বিপুল শক্তি বা জিয়োনকাঠি হলো গার্মেন্টস শিল্প। এই খাতে লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাদের ঝরানো ঘামেই আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণ এসেছে।

অর্থনীতি বেগবান হয়েছে। এরা আমাদের দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের হাতেই, তাদের ঘামেই দেশের উন্নয়নের ইট গাঁথা হচ্ছে। যত বড় বড় স্থাপনা হয়, অবকাঠামো হয় সেগুলো তৈরি করে যারা তারাই তো সেই মহান মানুষগুলো। তাজমহল বানানোর পর সবাই তার জন্য বাহবা দেয় স¤্রাট শাহজাহানকে। অথচ একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে এই তাজমহল তৈরি করতে গিয়ে কত শ্রমিকের ঘাম ঝরানো আছে। সেসব মানুষকে কেউ মনেও রাখেনি। প্রশংসা যেন তাদের প্রাপ্য নয়। সবাই স¤্রাটকেই বাহবা দেয়! যদি শ্রমিকের ঘাম না ঝরতো তাহলে কোথায় থাকত এই সুনাম? আজকের সভ্যতার প্রতিটি উন্নয়নের পেছনেই রয়েছে এই কুলি শ্রেণির মানুষের অবদান। আমরা সেই অবদান টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে চেয়েছি মাত্র।

তাও অনেক সময়ই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমাজের স্যুট বুট পরা বাবু সাহেবদের কাছে ঘামে ভেজা মানুষের দাম কোনোকালেই ছিল না। আমরা তাদের মূল্যায়ন কোনোদিনই করতে পারিনি। অথচ আজকের সভ্যতার চারিদিকে তাকালে যে বিলাসবহুল অট্টালিকা চোখে পড়ে, বড় বড় ইমারতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যে নির্মাণশৈলি আমাদের মনে কবিতার পঙ্ক্তি এনে দেয় তার পেছনে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের দু’হাতের শ্রম। আমরা কেবল এসব ইমারতের মালিককেই প্রশংসায় ভাসাই। পেছনে পড়ে থাকে এসব শ্রমিকের ইতিহাস। আমরা ভুলে যাই যে, সভ্যতার রূপায়ণ ঘটেছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে।

অথচ সেই হাতুড়ির সঠিক মূল্য আমরা কোনোদিনই দিতে চাইনি। তারা বারবার অধিকারহারা হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে তাই অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়।

আজ শ্রমিকদের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলেও আজও তাদের কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা যায়নি। বিভিন্ন খাতে যে শ্রমিক কাজ করছে তাদের ন্যায্য পাওনার সঙ্গে প্রতিটি কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী। তাদের কাজের ন্যায্য মূল্য আদায়ের ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণে রেখে তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে।

প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত