খালি গা ও ময়লা হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় গাড়ি ধুচ্ছিল যে শিশুটি, তার নাম স্বপন। স্বপন তার ঠিকানা জানে না। মা নেই, বাবাও নেই। স্বপনের ক্ষুধা আছে, ঘুম আছে, আছে শীত ও গরম। স্বপন গাড়ি ধোয়, ফুট-ফরমাশ খাটে ড্রাইভারের। এ করেই তার খাবার জোটে। রাতে শুয়ে পড়ে কোনো খুপড়ি কিংবা দোকানের বারান্দায়। করিম ঠিক স্বপনের মতো নয়। তার একটা ঠিকানা আছে। গ্রামের বাড়িতে ভাত ছিল না তার। তাই শহরে এসে কাজ নিয়েছে চা-স্টলে। রহিমের আবার অন্য পেশা। রাস্তায় ফেলে দেওয়া টিনের কৌটা, লোহা-লক্কড় ইত্যাদি কুড়োয় সে।
এই যে স্বপন, করিম কিংবা রহিম এরা কেউ ক্যালেন্ডার দেখে না। স্কুল-কলেজ তাদের কাছে অন্য এক জগৎ। এরা কেউ শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা আবুল ফজলের নাম জানে না। তবে এরা সবাই রাজ্জাক, শাবানাকে চিনে। সিনেমার নায়ক ভিলেনকে বদলা নিলে এদের আনন্দ হয়, হাততালি দেয়। আবার করুণ দৃশ্যে কেঁদে ওঠে এরা। এটাই যেন এদের মানুষ হিসাবে পরিচয়। এই স্বপন, করিম ও রহিম শিশুশ্রমিক। গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে এরা লক্ষ, লক্ষ। আজকের দিনে সভ্যতার ইমারত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে শিশুশ্রম বিক্রি হচ্ছে।
সারা দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উদ্বেগজনক এক চিত্র পাওয়া গেছে। দেশে গৃহপরিচারকের ৭৫ শতাংশই শিশু। শিশুশ্রম ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা অভিযান চলছে গত কয়েক দশক ধরে। এ নিয়ে সভা, সমিতি, সেমিনার কম হচ্ছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নাগরিক জীবনে তার কোনো প্রভাব পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। শিশু শ্রমিকের আলোচনা প্রসঙ্গে এসে যায় ‘স্ট্রিট চিলড্রেন’ অর্থাৎ রাস্তার শিশুর কথা। এরা রাস্তায় রাত কাটায়, শ্রম বিক্রি করে পেট চালায়। দেশের বিভিন্ন শহরে ও পথে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে।
সিলেট বিভাগের চা-বাগান, গার্মেন্ট শিল্প এবং বিভিন্ন এলাকার নির্মাণ কাজেও এখন সস্তায় শিশুশ্রম ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট রাজশাহী, খুলনা বা বরিশালসহ যে কোনো শহরেই রাস্তায়, দোকানপাটে ব্যাপকহারে শিশু শ্রমিক দেখা যায়। কিন্তু কেন এই প্রবণতা? প্রথম কথা হলো, অভাবের তাড়নায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে যারা, তাদের এক বড় অংশই শিশু। সস্তায় শ্রম কিনতে স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হচ্ছে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রের উদ্যোগীরা। গ্রামের অভাবী মা-বাবাও বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিচ্ছে শহরে কাজ করতে। তাতে বাচ্চারও পেট চলবে, মা-বাবাও কিছু পয়সা পাবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্কুলছুট ছেলে-মেয়েরাও কাজে লেগে পড়ছে। এভাবেই বাড়ছে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা। শুধুমাত্র ভাষণ-বক্তৃতায় এই প্রবণতা কতটা রোধ করা যাবে, এটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
শিশু-শ্রমকে গৃহ নির্মাণ, কল-কারখানা এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই তিনটি ক্ষেত্রেই বিপুল সংখ্যক শিশু শ্রমিক কাজ করছে এবং দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। নির্মাণকাজ এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে বহু সংখ্যক শিশু শ্রমিকের দেখা মিলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যে কোনো শহর কিংবা গঞ্জের হাটে আমরা এদের দেখতে পাই। কেউ গাড়ি ধোয়ার কাজ করছে, কেউ বাস কন্ডাক্টর, কেউ বা গাড়ি থেকে মালামাল নামাচ্ছে। নির্মাণকাজেও বহুল ব্যবহার ঘটছে শিশু শ্রমের। মিস্ত্রিদের জোগালির কাজ করানো হচ্ছে শিশুদের দিয়ে। আবার মোস্তফার মতো নাবালকও আছে। সে সিলেটে রিকশা চালায়। বলছিল সে, ‘পেটের জন্য এছাড়া উপায় নেই’। অভাবের তাড়নায় শহরে চলে আসে। প্রথম ছিল শহর-প্রান্তে এক চা-স্টলে। পয়সা খুবই কম, সঙ্গে মালিকের বকাঝকা। তারপর রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে পনের বছরের ছেলেটি। এখন মা-বাবাকেও কিছু পয়সা দিতে পারে সে। আসলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে তীব্র বৈষম্যই শিশু শ্রমিকের জন্ম দিচ্ছে। গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থা আজ বিপর্যস্ত। তাই মানুষ দেশের মেরুদণ্ড গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে শহরে চলে আসছে। শহরে এসে বাচ্চাটির কোনো ব্যবস্থা না হলেও শ্রমিকের কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া কাজ সহজ। এভাবেই নিষ্পাপ শিশুটি তার সামাজিক এবং শিক্ষাগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পারিবারিক চাপ বা স্বাবলম্বী ভাবটাও অনেক শিশুকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা ভাবায়। ফলে শিশু কাজের মধ্যে ডুবে যায়। শহরাঞ্চলে এরকম বহু শিশু শ্রমিক ছড়িয়ে রয়েছে নানা কাজে। এরা যে শিশু শ্রমিক তাও এদের জানা নেই। এরা শুধু জানে কাজ করলে খাবার মিলবে। শিক্ষা বা অন্য সব কিছু এদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার। এ ব্যাপারে এদের কোনও আক্ষেপও নেই। এরা যেন এ জন্যই জন্ম নিয়েছে।