ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আমাদের ভেতর অদৃশ্য অপরাধ জন্ম নিচ্ছে!

সাঈদ চৌধুরী
আমাদের ভেতর অদৃশ্য অপরাধ জন্ম নিচ্ছে!

যখন লিখতে বসছি, তখন মা তার দুই সন্তানকে হত্যার জঘন্যতম একটা বর্ণনা দিয়েছেন তা জেনে কী-বোর্ডের অক্ষরগুলো চাপছি! গাজীপুরের টঙ্গীর এই ঘটনার কথা কীভাবে লিখলে আমাদের শিশুদের মনে কোনো প্রভাব পড়বে না সেটি বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব! ছোট ছোট শিশুরা যখন শুনতে পায় মা তার সন্তানকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে- নিজেকে ওই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখলে অনুভব করা যায়! সন্তান বিক্রি করে মোবাইল ফোন কেনার মতো ঘটনা যখন পত্রিকার পাতায় আসে, তখন সন্তান বড় হওয়ার পর কী দায়িত্ব নিতে চাইবে বাবা-মায়ের! এই ঘটনাগুলো বিকৃত মস্তিষ্কের; খুব কম সংখ্যক মানুষের হলেও এর প্রভাব বিস্তর ও গাঢ়! অস্থির অবস্থার একটা সীমা থাকে। আমরা এ কোনো অস্থিরতায় এসে পতিত হচ্ছি। কারও কথা কারও গায়েই সহ্য হয় না। মনে হয় এক্ষুনি ধরে বুঝি গলায় ছুরি চালিয়ে দেবে। অটোচালকদের বিক্ষোভের একটা ভিডিও দেখছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গত সোমবারের ঘটনা এটি। একটি মোটরসাইকেলওয়ালাকে দেদারসে পেটাচ্ছে, বিদেশি একজন নাগরিকের কুকুরসহ কী হেনস্তা করছে! মনস্তাত্বিক একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে- আমাদের পুরো সামাজিক অস্থিরতার কারণেই।

দাবির পেছনে ভর করেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার তীব্র লালসা আর যারা ক্ষমতা হারিয়েছে তাদের নোংরা পদচারণা! সমাজের এ প্রভাবগুলো সংসার জীবনেও কেন আসলো! যে মা মানসিকভাবে অসুস্থতার কথা বলছে তিনি কেন মানসিকভাবে অসুস্থ হলেন। এর দায় কি সবার উপর পড়ে না? ওনার স্বামী দেশের বাইরে ছিলেন। টাকার অভাব পূরণ করেছে এবং করতে গিয়েই দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। অবাধ সম্পর্কের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একজন মানুষ আরেকজনকে ছাড়া থাকাকে কি স্বাভাবিকভাবে নেয়, নাকি অন্য সম্পর্ক করে অথবা মানসিক অশান্তিতে ভুগে এমন হয়ে যায়?

মানসিক যন্ত্রণা থাকাও তো অস্বাভাবিক নয়। নানামুখী চাপ ও একাকিত্বতা থেকে মানুষের যে আচরণিক পরিবর্তন হয় তাতো প্রকৃতিগতই। এ সব বিষয়গুলো যেমন ভাবতে হচ্ছে- তেমনি ভাবতে হচ্ছে আমরা কোথায় পেরে উঠছি না। সঙ্গে সঙ্গে ব্যত্যয়গুলো নিয়ে প্রশ্নগুলো; কিন্তু সামনে আনতে হচ্ছে। মোবাইল ফোন কেনার জন্য যে মা সন্তান বিক্রি করল তিনি কীভাবে অসুস্থ হলেন মানসিকভাবে? তিনি কি অভাব বোধ থেকেই অসুস্থ হলেন? যদি তাই না হন, তবে দেখতে হয় ওনাকে কে এই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত করেছে। আমরা অপরাধীর অপরাধ দেখি। কিন্তু ভেতরকার উৎসাহদাতা, সহায়তাকারী বা উসকে দিয়ে অপরাধ করার প্রবণতা তৈরি কারককে কখনোই দেখি না। এখানে একটা বড় ফারাক থেকে যায়! একারণে অপরাধের ধরন শনাক্ত হলেও এ বিষয়ে কাজ করে এগিয়ে যাওয়া যায় না। তারপর আবার অপরাধের একটি চিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রচারিত হয়ে যায়। মানুষ নানাভাবে নিজেদের মতো করে অপরাধ বিশ্লেষণ করে ফেলে।

যাই হোক দিন শেষে এই অপরাধগুলো প্রচারের ক্ষেত্রেও আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যেভাবে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে, সেভাবে আমরা এখন নৈতিক শিক্ষাও দিতে পারছি না। একেবারে কম হলেও বলাৎকারের মতো ঘটনা শুনতে হয়, এখনও তা আবার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

ধর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কাজ হলে এই বিকৃতির জন্য দায়ী কাকে করবেন? কীভাবেই বা ব্যখ্যা করা যায়? রোববারে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে অযথা একটি কারণে খুন হলো! কোনো অনুশোচনা আছে যে ওকে খুন করেছে? হয়তো সে ভাবছে আইনের ফাঁক গলে বের হয়েতো যাবই। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো বিষয় থাকাও অস্বাভাবিক নয়! কিন্তু পরবর্তী শাস্তির কথা চিন্তা করেও অপরাধ কমছে না কেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। সামাজিক ভয়াবহ অপরাধের পেছনে নেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরকীয়া এবং কিশোর গ্যাং! এই পরকীয়া হওয়ার পেছনে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তিই কি শুধু দায়ী? তা কিন্তু নয়। ঘরে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সময় না দেওয়া, অবহেলা, অন্যের সাথে খারাপভাবে তুলনা করাসহ নানা কারণ আছে এর পেছনে। খুব খেয়াল করে দেখবেন সন্তান বড় হয়ে যাবার পর স্বামী স্ত্রী ফিজিক্যালি তাদের আকর্ষণ হারায়। আবার তারাই অন্যের সঙ্গে অবৈধভাবে ফিজিক্যালি সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারমানে স্পষ্ট। তারা আসলে আকর্ষণ হারায় না বরং প্রয়োজনীয়তাকে অবদমিত করে রাখবার বৃথা চেষ্টা করে। এই বৃথা চেষ্টা যখন অন্যে উসকে দেয় তা হয়ে ওঠে অপরাধের অগ্নিমূর্তি!

সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সব সম্পর্ক যত বেশি গাঢ় থাকবে অপরাধ, তত কমবে বলে ধরা যেতে পারে।

কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো করে আমরা কি আমাদের পরিবারগুলোকে শিক্ষা দিতে পারছি। অনেকেই বলে ধর্ম শিক্ষা ঠিকভাবে দিলেই ভয়ে অপরাধ করবে না। কিন্তু এখন অপরাধের যে ধরন তাতে শুধু ধর্ম শিক্ষা নয় বরং এর সঙ্গে প্রয়োজন বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি করা, একে অপরের প্রতি আকর্ষণ ধরে রাখা, তুলনার জায়গা কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলো। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও এক্ষেত্রে বড় নিয়ামক বলে ধরা যেতে পারে। এখন কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষেত্রেও রোডম্যাপ অনেক ভেতর থেকে শুরু করতে হবে। যেমন বাবা-মা সময় না দিলে শিশুরা তো বখে যাবেই। অনেক বাবা-মা তার সন্তানকে আলাদা রাখার জন্য একটা মোটরসাইকেল ও মোবাইল কিনে বাইরে থাকার জন্য উৎসাহ দেয়। ঘরে ফেরার জন্য কোনো তাড়া দেয় না এবং কী করছে তার সন্তান তারও কোনো খোঁজ রাখে না। আমাদের ভেতরকার অপরাধ উসকে দেওয়ার জন্য যে যে ইনডিকেটরগুলো কাজ করছে, সেগুলোকে আস্তে আস্তে সীমার মধ্যে আনতে হবে। নইলে ভভিষ্যতে এর মতো বড় ও গহিন অন্ধকার আর কিছুই থাকবে না। আমাদের শিক্ষা কোনো কাজেই লাগছে না, আমরা দিন দিনই নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে খেয়াল করে দেখুন সন্তানদের সুস্থ বিনোদনের জায়গা কমেছে, খেলার মাঠে খেলার আনন্দ কমেছে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটানোর উদযাপন কমেছে, নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আলোচনার জায়গা কমেছে। তারমানে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাওয়া একটি বড় কারণ সব কিছুর পেছনে।

স্কুলগুলোতেও খোপকেন্দ্রিক পড়াশোনা করার কারণে নৈতিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। খেলাধুলা বিহীন জীবনে শিশুরা হয়ে পড়ছে একমুখী! এসব কারণে ভালো উদাহরণ খুঁজতে এখন বেগ পেতে হয়। এটা কোনো সামাজিক রীতি হতে পারে না। আমাদের পথগুলো খুঁজতে হবেই। আমাদের ভেতরকার অপরাধ তৈরির জায়গাগুলোতে এন্টি অপরাধ ঢোকাতে হবেই। মানুষকে অপরাধের এ জঞ্জাল থেকে বের করে এনে সুস্থ একটি সমাজ বিনির্মাণ বড় কাজ। আমরা আমাদের শিশুদের সামনে ভালো কথা বলতে চাই। তারা যাতে ভালো কথাগুলো শুনে শুনে ভালো হবার উপলক্ষ খুঁজে পায়। তাদের মনস্তাত্বিক বোধের জায়গায় যাতে সমাজ নিয়ে একটা সুদৃঢ় চিন্তা থাকে, একটা মনন থাকে এবং নিজেকে দেশের জন্য তৈরি করবার একটি লক্ষ্য তৈরি হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত