ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাজেটের আকার, বাজেটের প্রকার

অলোক আচার্য
বাজেটের আকার, বাজেটের প্রকার

নতুন অর্থবছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশ। সেইসঙ্গে একটি নতুন বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেট এমন একটি সময়ে আসতে যাচ্ছে যেখানে বিশ্বজুড়ে একটি দুঃসময় চলছে।

চারিদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে, ইসরাইলের গাজায় সামরিক অভিযান চলছে, ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা, নতুন করে রোহিঙ্গা দেশে প্রবেশের সম্ভাবনা ইত্যাদি। বাংলাদেশও একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই ধারায় এবার বাজেট হতে যাচ্ছে। বাজেট যতটা না সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তার থেকেও বেশি সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ জড়িয়ে থাকে। বাজেট বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে বাজার। আর বাজার অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধ বা কম। এজন্যই বাজেট নিয়ে ভাবনা থাকে। কেমন বাজেট হবে, বাজেটের কতটা বাস্তবায়িত হবে অথবা কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে বা কমবে। দেশের খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি এখনও আশঙ্কার। জনগণের ভোগ্যপণ্যের দাম আরও হাতের নাগালে আনতে হবে। এছাড়াও বেকারত্ব কমাতেও প্রচেষ্টা করতে হবে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবই হবে বাজেটে।

এ কারণেই বাজেট ছোট হবে না বড় হবে তার থেকে বাজেট কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে সেই প্রশ্ন থাকে জোরালোভাবে। একটি কার্যকরী বাজেট জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে। এজন্য শুধু বাজেট প্রণয়ন করলেই চলে না বাজেটের বাস্তবায়নের হারও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও নানা কারণে স্বাধীনতার পর থেকে ঘোষিত বাজেটের শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। শতভাগ না হোক একটি মানসম্মত পরিমাণ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। সে কারণে চেষ্টা করা উচিত যত বেশি সম্ভব বাজেট বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের বাজেটের আকার প্রতি বছরই বড় হয়েছে। একই সঙ্গে উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানো ইত্যাদি বিষয়গুলো বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য তাই বাজেট প্রণয়ন একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ প্রয়োজন।

সুতরাং এবারের বাজেট গতবারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং। অর্থনীতি চাঙ্গা করে মানুষের জীবন মান উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের গতি ধরে রাখা এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যয়ের চাপ কমানো এই বাজেটের চ্যালেঞ্জ থাকে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

বাজেট ঘোষণার আগে জনগণের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। বিশেষত বাজেটের আকার নিয়ে। তবে বাজেট উচ্চাবিলাসী হোক এটা আর জনগণ চায় না। বাজেট হোক বাস্তবসম্মত।

অর্থাৎ আমি যতটুকু সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারব এবং যোগান দিতে পারব ততটুকুই হোক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রে যতটুকু জানা গেছে, এবারের (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে আগের তুলনায় ছোটো। আগামী ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হবে। সম্ভাব্য নতুন বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর সেটি বাস্তবায়ন করতে দেশি ও বিদেশি মিলে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ করতে হবে।

যার মধ্যে বিদেশি ঋণ প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এক লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা)। জাতীয় সংসদে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। উচ্চঋণ, দুর্বল বিনিয়োগ এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এই প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করতে পারে। অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে গত দুই বছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) গবেষণা তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৭৮ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার মধ্যে ৩৮ লাখ লোক অতি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আর ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও বড় বাজেটের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

এবার আকার ছোটো হলেও যদি বাস্তবায়নের হার বেশি হয় তাহলে বাজেট স্বার্থক হবে। এটা করতেই হবে। এর বাস্তবায়ন অবশ্যই চ্যালেঞ্জের। নতুন বাজেটে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমন্বয় ঘটাতে হবে। কারণ জনগণের এখন প্রত্যাশা বেড়েছে। দেশকে নতুনভাবে এগিয়ে নিতে হবে। আর সেজন্য চাই নতুন পরিকল্পনা।

বাজেট একটি দেশের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বাজেট প্রণয়ন নয় বরং বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ হয় সরকারের জন্য। প্রান্তিক জনসাধারণের কাছে বাজেটের সুফল পৌঁছানো এবং দেশকে গতিশীল অভিমুখে ধাবিত করাই বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য থাকে। রাজস্ব আদায়ের গতি বৃদ্ধি করা, ব্যাংক খাত শক্তিশালী করে ঋণখেলাপির সংখ্যা কমিয়ে আনা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা, নতুন কর্মসংস্থানের উৎস সৃষ্টি করা, শিক্ষার মানোন্নয়ন করা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ থাকে বাজেটে।

দিন শেষে সাধারণ জনগণ এটা জানতে চায় না যে, বাজেট কত ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে কিন্তু দিনশেষে এটা জানতে চায় বাজারে কোন নিত্যপণ্যের দাম কত বেড়েছে বা কমেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাজেট ঘোষিত হয়। এই মুহূর্তে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা। এছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেরও দাম চড়ছে। বাজেট ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই মিডিয়াসহ সর্বত্র বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। আসছে বাজেট কেমন হবে এবং বিগত বাজেট কেমন ছিল বা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েই এসব আলোচনা চলে। অর্থনীতি গতিশীল করতে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে এই বাজেট সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে বলেই বিশ্বাস।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। তারপর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। বহু উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে এশিয়ার অর্থনীতিতে শক্তিশালী দেশ হওয়ার কাতারে দাঁড়িয়ে। সময়ের সঙ্গে যেমন বেড়েছে লোকসংখ্যা, বেড়েছে প্রয়োজন আর সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাজেটের আকার।

বাজেটের সঙ্গে দেশের জনগণের জীবনমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের উন্নয়ন জড়িত। ফলে বাজেট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেটের প্রভাব পড়ে বাজারে। কারণ বাজেটে কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে বা কমবে তা স্থির করা হয় এবং মিডিয়ার কল্যাণে সেসব একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্রেতা ও বিক্রেতারাও সেটি পড়ে থাকে। বাজেটের পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও আমাদের দেশের একটি সাধারণ ঘটনা। এমনকি দাম বাড়ার কথা শুনেও অনেকে দাম বাড়িয়ে দেন।

ফলে মূলত এর ঝামেলায় পড়েন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষরা। কারণ এমনিতে সারা বছর তাদের হাতের অবস্থা টালমাটাল রয়েছে। এরমধ্যে আবার বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে তা আরও খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা বিশেষত মানুষের জীবন ও জীবিকা সহজতর বা চাপ কমানোর প্রচেষ্টাই বেশি প্রাধান্য পাবে।

এরপরই আসে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের বিষয়। এর প্রথমেই রয়েছে কর্মসংস্থান। বেকারত্ব সমস্যা স্বাভাবিক সময়েই অধিকাংশ দেশের জন্যই মাথাব্যথার কারণ। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় বেকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

বেকারত্ব, ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যতা এই তিন ফল আপাত যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পৃথিবী মোকাবিলা করছে এবং আগামী বহু বছর করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক কাজে সংশ্লিষ্ট করা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন রয়েছে। খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদ নিশ্চিত করার জন্য কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। দেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চার করার জন্য প্রয়োজন কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমাদের কৃষির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

কৃষিই পারে খাদ্য সংকটের মতো পরিস্থিতিকে টিকিয়ে রাখতে। এসবের সঙ্গে সবচেয়ে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষাকে যুগোপযুগী করে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ থাকবে। যত দিন শিক্ষাকে যুগোপযুগি এবং আন্তর্জাতিকমানের করা না যাবে ততদিন দেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাবে না। প্রয়োজন দক্ষ ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

ফলে এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। বাজেটের সফলতা নির্ভর করে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। সেটি কতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে সেটি বিবেচ্য। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব নয় তবে যত কাছাকাছি বাস্তবায়ন করা যায় ততই বাজেটের সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত