ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আদানি চুক্তি ও দুর্নীতির দায়

এমএ হোসাইন
আদানি চুক্তি ও দুর্নীতির দায়

দুর্নীতির এক বিশেষ ধরন আছে, যা উন্নয়নের মোড়কে আত্মপ্রকাশ করে- যেখানে সরকারের একটি অসাধু মহল ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলো একে অপরের সুবিধার জন্য গোপন আঁতাতে জড়িয়ে পড়ে, অথচ মূল্যটা গুণতে হয় সাধারণ জনগণকে। ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের যে বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছে, তা এই ঘৃণ্য বাস্তবতার এক নিখুঁত উদাহরণ। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সাধারণ বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি মনে হলেও, এটি এখন এক গভীর ষড়যন্ত্রে রূপ নিয়েছে। যার মাধ্যমে এক শক্তিশালী বিদেশি কোম্পানি বিপুল কর ফাঁকি দিয়ে গেছে, আর তার বোঝা বইতে হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণকে। অভিযোগগুলো যেমন গুরুতর, তেমনি সুস্পষ্ট। ভারতের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপ আদানি, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি লাভজনক চুক্তি করে- যার মাধ্যমে আমাদের উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হয় এবং একই সঙ্গে আদানি গ্রুপকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন টাকা কর মওকুফ দেওয়া হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই কর ছাড় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমোদন ছাড়াই দেওয়া হয়; এবং এটি হয়েছে নানা গোপন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। এই ধরনের অস্বচ্ছতা কোনো সাধারণ প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং ইচ্ছাকৃত ব্যবস্থা। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মানলে হয়তো এই চুক্তি স্বচ্ছতার অভাবে বাতিল হয়ে যেত।

এ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন উঠে আসে- দক্ষিণ এশিয়ায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ধরন সম্পর্কে, যেখানে রাজনৈতিক আনুগত্য আর কর্পোরেট সম্প্রসারণের মধ্যে পার্থক্য ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আদানি চুক্তিটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি ছিল আগের সরকারের কিছু বৃহৎ প্রকল্পের একটি অংশ, যা ‘উন্নয়ন’ ও ‘প্রতিবেশীর সহযোগিতা’র প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এসব কূটনৈতিক চটকদারতার আড়ালে যে কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে ছিল, তা হলো- এই চুক্তিটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র কিংবা বাজার দক্ষতার মাধ্যমে হয়নি, বরং দিল্লি ও ঢাকার রাজনৈতিক ক্ষমতার ঘনিষ্ঠতা থেকেই এটি এসেছে। এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে রয়েছেন একজন প্রাক্তন মুখ্য সচিব, যিনি আলোচনার সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, তিনি ও তৎকালীন হাসিনা সরকারের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা এই চুক্তিটি স্বাভাবিক পর্যালোচনার প্রক্রিয়া এড়িয়ে দ্রুত বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন তদন্ত শুরু করলেও, তাদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি), যাদের কাছে এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে, তারা দুদকের অনুরোধে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেও সাড়া দিচ্ছে না। এটি শুধু আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব নয়- এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদি প্রতিবন্ধকতা।

প্রশ্ন উঠছে: লুকানোর কিছু না থাকলে সহযোগিতায় বাধা কোথায়? এই ব্যবস্থার মানবিক খরচও অনস্বীকার্য। যেখানে আদানি বিশাল করছাড় উপভোগ করেছে, তখন সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিকরা ভুগেছে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির সংকট এবং স্থবির মজুরির চাপে এবং তাদেরই বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। এটিই ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ পুঁজিবাদের মূল চরিত্র: লাভ কর্পোরেশনের, ক্ষতি জনগণের। সরকার জনগণের সম্পদের অভিভাবক না হয়ে কর্পোরেট শোষণের সহায়ক রূপে কাজ করছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিগত কয়েক বছর ধরেই চাপের মুখে রয়েছে। জ্বালানি, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে, অথচ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিটি ডলার প্রতিটি টাকা গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিদেশি বিনিয়োগ’ নামক মোড়কে কয়েক কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব হারানো শুধু স্বল্পদৃষ্টির পরিচয় নয়; এটি চরম দায়িত্বহীনতা। তার উপর, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোদ্দা থেকে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য যে খরচে আসছে, তা স্থানীয় উৎসের তুলনায় অনেক বেশি। এ নিয়ে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে; এই চুক্তির মাধ্যমে কি আদৌ জনগণের উপকার হয়েছে, নাকি এটি কেবল রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি একটি দলের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করার উপায় মাত্র?

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিতর্কিত চুক্তি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য দেশেও রয়েছে। ভারতে শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানো ও সম্পদের মূল্য অতিরঞ্জনের অভিযোগ রয়েছে। যদিও আদানি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবুও অভিযোগের পরিমাণ ও গুরুত্ব এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মানা যায় না। ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের একটি প্রতিবেদন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে, যেখানে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘নির্লজ্জ শেয়ার কারসাজি ও হিসাব জালিয়াতির’ অভিযোগ আনা হয়। এর ফলে শেয়ারবাজারে বিলিয়ন ডলারের ধস নামে এবং ভারতে ও আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তদন্ত শুরু করে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল অভিযোগ হলো- সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আদানি গ্রুপকে অবৈধ করছাড় দেওয়া হয়েছে। যদি এটি প্রমাণিত হয়, তবে এটি কেবল একটি কর্পোরেশনের লোভ নয়; এটি হবে একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির চিত্র- যেখানে কর্পোরেশন ও সরকারি কর্মকর্তা উভয়ই জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী যদি আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে প্রশাসনিক সহায়তা পায় এবং কোনো জবাবদিহির মুখোমুখি না হয়, তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তদন্তের পথ যেন অবরুদ্ধ না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে- এই করছাড় কি আইনসঙ্গত ছিল, নাকি একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকারের বিশেষ মদদপুষ্ট কর্পোরেশনের জন্য বিশেষ সুবিধা? এনবিআরকে পাশ কাটানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল, কোন ক্ষমতার ভিত্তিতে? সাবেক কর্মকর্তারা কীভাবে এই চুক্তিকে ত্বরান্বিত করেছেন? আর পিডিবি কেন প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে? দুর্নীতির একমাত্র প্রতিষেধক হচ্ছে স্বচ্ছতা, আর তা না থাকলে জনগণের আস্থা ক্রমশই ক্ষয়ে যাবে। নতুন সরকার, যারা সংস্কার ও জবাবদিহিতার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের এখন নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের মুহূর্ত। তারা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে, যেটি হয়তো অতীতের ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে যাবে, নাকি চেনা পথে হেঁটে সবকিছু ধামাচাপা দেবে? মনে রাখতে হবে, একটি দেশ এক দিনে দুর্নীতিগ্রস্ত হয় না। দুর্নীতি ধীরে ধীরে প্রবেশ করে- নীরব সম্মতিতে বৈধতা পায়, আর বিচারহীনতার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। সারকথা, এটি শুধু একটি চুক্তির প্রশ্ন নয়- এটি প্রশ্ন তোলে, বাংলাদেশ কেমন দেশ হতে চায়? যদি রাষ্ট্র দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, তবে সেটি আর ন্যায়নিষ্ঠ বা গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা বলতে যদি কিছু থাকে, তাহলে তাদের কর্পোরেট প্রভাব ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আদানি কেলেঙ্কারি প্রমাণ করার সুযোগ- কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন। বাংলাদেশের জনগণ এর চেয়ে কম কিছু পাওয়ার যোগ্য নয়।

এছাড়াও, এই ঘটনা আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কিত কৌশল নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। বিনিয়োগ নিজেই কোনো লক্ষ্য নয়; এটি টেকসই উন্নয়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ন্যায্য প্রবৃদ্ধির একটি মাধ্যম। এমন চুক্তি, যা শুধুমাত্র বিনিয়োগকারী ও কিছু কর্মকর্তার উপকারে আসে তা মূল লক্ষ্যকেই ব্যর্থ করে দেয়। সরকারকে এখন কঠোর নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং কর আইন প্রয়োগে কোনো ব্যতিক্রম করা চলবে না।

তদন্ত হোক বাধাহীন। সত্য উন্মোচিত হোক। আর বিচার হোক-নির্বাচিতভাবে নয়, সবার জন্য সমানভাবে। এর কম কিছু হলে, জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে আরেকবার বিশ্বাসঘাতকতা হবে। বাংলাদেশ কর্পোরেট লোভ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার খেলাঘর হতে পারে না। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যদি তার অবস্থান দৃঢ় করতে চায়, তবে কর্পোরেট ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের অন্ধ ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতেই হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত