ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : চিরজাগরিত এক প্রজ্ঞার প্রতীক

মো. রবিন ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : চিরজাগরিত এক প্রজ্ঞার প্রতীক

বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বিশাল আকাশের নামণ্ড যার দীপ্তি যুগ থেকে যুগান্তরে বাঙালি মননে আলো ছড়িয়ে গেছে। ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ (৭ মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নেওয়া এই মহান কবি, দার্শনিক, সুরস্রষ্টা ও নাট্যকার শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। তার জন্মদিন, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বাঙালির এক আত্মিক উৎসব, যা কেবল তার জন্মস্মরণ নয়, বরং এক নিত্যনতুন নবজাগরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ঠাকুরবাড়ির এক অভিজাত, সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে। তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি এবং মা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণা। বাড়ির পরিমণ্ডলেই রবীন্দ্রনাথের শিল্পবোধ ও মননশীলতা বিকশিত হতে থাকে। প্রথাগত স্কুলশিক্ষা তার তেমন পছন্দ ছিল না। ঘরে ঘরে শিক্ষকদের কাছেই তিনি জ্ঞানার্জন করেন। পরে ইংল্যান্ডে গিয়েও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন, যদিও ডিগ্রি অর্জন করেননি।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসীম অবদানের কারণে তাকে কবিগুরুর আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি তার জীবনকালে একদিক ছোট কবিতা ও গল্প থেকে শুরু করে বড় বড় উপন্যাসের রচনা করেছিলেন। নি¤েœ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সম্পাদিত কিছু সাহিত্যকর্মের উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে-

ছোট গল্প: কিশোর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার লেখার জীবন শুরু করেছিলেন ‘ভিখারিণী’ দিয়ে। তার জীবনের প্রথম পর্যায়ে, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো পরিবেশিত হয়েছিল যেখানে তিনি বড় হয়েছিলেন তার আশপাশের পরিবেশ নিয়ে।

পরবর্তীকালে তিনি তার গল্পগুলোতে দরিদ্রদের দুর্বল সমস্যা এবং সমস্যাগুলোকে কীভাবে নিরাময় করা যেতে পারে সেই বিষয়গুলোকে তুলে ধরতেন, এছাড়া তিনি হিন্দু বিবাহের নেতিবাচক দিক এবং এমন অনেক রীতিনীতি নিয়ে তার গল্পের মধ্যে আলোচনা করতেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি বিখ্যাত ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ক্ষুদিতা পাশান’, ‘আতোটজু’, ‘হৈমন্তি’ এবং ‘মুসালমণির গোলপো’ এর মতো আরও অনেক গল্প।

কবিতা: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কালীদাসের মতো প্রাচীন কবিদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন এবং এ থেকে তার কবিতা ও রচনা প্রায়শই পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর শাস্ত্রীয় সাহিত্যিকদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। তার নিজস্ব রচনাশৈলীর সাহায্যে তিনি মানুষকে কেবল তার নিজের রচনায় নয়, প্রাচীন ভারতীয় কবিদের রচনায়ও মনোনিবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘সোনার তরী’, চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা, ক্ষণিকা, চিত্রা এবং ‘গীতাঞ্জলি’ ইত্যাদি।

উপন্যাস: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন, বলা হয় যে কবিগুরুর রচনায় তার উপন্যাসগুলো বেশি প্রশংসিত হয়েছে। তিনি তার রচনায় অন্যান্য যথাযথ সামাজিক কুফলগুলোর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি তার গল্পটি লিখেছেন তার একটি গল্প উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’তে প্রধান চরিত্রের কবিতা এবং ছন্দময় অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে লেখা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে নৌকাডুবি, ‘গোরা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘যোগাযোগ’ দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন শুরু হয় কৈশোরেই। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে- ‘ভানুসিংহ ঠাকুর’। ‘সন্ধ্যা সংগীত’, ‘প্রভাত সংগীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালি’, ‘বলাকা’, ‘শেষ লেখা’- প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তার কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। ১৯১৩ সালে তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, যা বাংলা ও ভারতের সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

তিনি একাধারে ছিলেন উপন্যাসকার, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও চিত্রশিল্পী। ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গোরার’ মতো উপন্যাসে তিনি তৎকালীন সমাজ, নারীর অবস্থান, দেশপ্রেম, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও আত্মঅন্বেষণের প্রশ্ন নিয়ে গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। তার ছোটগল্পে (‘কাবুলিওয়ালা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘দেনা-পাওনা’ ইত্যাদি) দেখা যায় নিখুঁত জীবনচিত্রায়ন এবং সাধারণ মানুষের অন্তরজগতে প্রবেশের এক অসাধারণ ক্ষমতা।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সংগীতপ্রেমী ও সুরস্রষ্টা। প্রায় ২২০০-এর অধিক গান রচনা করেন তিনি, যা ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে পরিচিত। এই গানগুলোতে প্রেম, প্রকৃতি, মানবতা, ভগবান, দেশপ্রেম ও দর্শন- সবই একাকার। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে, যা বাঙালি জাতির জন্য গৌরবের বিষয়।

অবসরের সময় তিনি চিত্রাঙ্কন শুরু করেন, এবং এই ক্ষেত্রেও তার সৃষ্টিশীলতা ও স্বকীয়তা প্রশংসিত হয়। তার আঁকা ছবিতে দেখা যায় বিমূর্ততা, প্রতীকী রূপ ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বৃহৎ অবদান হলো শিক্ষাব্যবস্থায়। তিনি ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তার শিক্ষাদর্শ ছিল প্রকৃতিনির্ভর, মুক্তচিন্তাশীল ও শিল্পসংশ্লিষ্ট। তার মতে, ‘শিক্ষা হওয়া উচিত জীবনের জন্য প্রস্তুতি নয়, বরং জীবনেরই এক স্বাভাবিক অঙ্গ।’

সাহিত্য সংস্কৃতির বাইরেও রবীন্দ্র প্রতিভা বিস্তৃত। তিনি একাধারে সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক, সর্বোপরি মানবাতাবাদী দার্শনিক। শিক্ষা ও কৃষির ক্ষেত্রে তিনি যে চিন্তাভাবনা করে গেছেনে তা শতবর্ষ পরে এসেও প্রাসঙ্গিক ও ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ উপযোগী। তিনি জমিদার ছিলেন। জমিদারি পরিচালনার জন্য তাকে আসতে হয়েছিল গ্রামবাংলার সান্নিধ্যে। তিনি গ্রামীণ বাংলার সমস্যা চিহ্নিত করে তা নিরসনকল্পে যে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বা সমাধানের পথ বাতলে গেছেন বাংলাদেশের গ্রামোন্নয়নে বর্তমানেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কাব্যভাবনার বাইরের আরেকটি অবশ্য উল্লেখ্য, রাবীন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য হলো তিনি একজন সফল সমাজ সংস্কারক বিশেষত পল্লি সমাজ সংগঠক। তার দৃষ্টিতে গ্রামই ভারতবর্ষে প্রাণ এবং গ্রামোন্নয়নেরই এর প্রবৃদ্ধ। তাই ১৮৯৬-এর ৮ আগস্ট শিক্ষানবিশ শেষে আম মোক্তারনামা মূলে পিতার নিকট থেকে জমিদারির কর্তৃত্ব লাভের পর থেকেই তিনি গ্রামীণ সমাজের সংস্কারের জন্য মনোনিবেশ করেন।

তিনি গ্রামীণ সমাজের নানা সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং তা সমাধানের জন্য একাদারে কাজ করে যান। কৃষকদের নানা সংকট মোকাবিলায় তার সে সময়ের পদক্ষেপগুলো ছিল যুগান্তকারী। তিনি শহরের ধনীর দুলাল হয়েও পল্লি সমাজের কৃষকের কল্যাণে, গ্রামের রাস্তাঘাট, পানীয় সংকট নিরসনের জন্য কূপ খনন, পুকুর সংস্কার, দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, শিক্ষার বিস্তার, যান্ত্রিক চাষাবাদ, কৃষি সমবায়, ক্ষুদ্র ঋণ দান, স্বাস্থ্যসেবাভিত্তিক সমবায় প্রথার প্রচলন, জমিতে জৈব রাসায়নিক সার ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, শস্য বহুমুখীকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করেন এবং তা সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেন। আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে রাজশাহীর পতিসরে ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে তার প্রতিষ্ঠিত আদর্শ কৃষিখেত সেচ পাম্প, কলের লাঙল বা টাক্টর, উন্নত বীজ ও জৈব সারের ব্যবহার প্রবর্তিত করেন। নামমাত্র সুদে কৃষকদের ঋণদানের লক্ষ্যে ব্যাংক চালু করা হয়। এর ঋণদান ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির জন্য তিনি তার নোবেল পুরস্কারের অর্থও এখানে বিনিয়োগ করেন। জমিদারি সেরেস্তার সেরেস্তাদারি বিকেন্দ্রায়িত করে তিনি মণ্ডলী প্রথা প্রবর্তন করেন। এতে সেরেস্তাদের উৎপীড়ন ও ভোগান্তি থেকে রায়তগণ অব্যাহতি পান। তিনি কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। তিনি কৃষকদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে উৎসাহিত করেন। জমির বাঁধে তিনি কৃষকদের শাক-সবজি আবাদে উৎসাহিত করেন। বাঙালি বা ভারতবিদ্বেষী ব্রিটিশ আমলা কবিগুরুর কাব্য-ভাবনার বহির্ভূত কল্যাণমূলক ও সমাজ সংস্কারধর্মী কাজের প্রতিভূ প্রশংসা করেছেন। কবিগুরুর মতো আমারও নিজ নিজ সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন করতে পারি।

তিনি রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় ছিলেন না, তবে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা মুহূর্তে তার লেখনী তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ হয়ে উঠেছে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। তার ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে দেখা যায় উপনিবেশবাদ বিরোধী এক গভীর দর্শন ও মানবতাবাদী কণ্ঠ।

১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন, কিন্তু তার সৃষ্টি আজও জীবন্ত। তার সাহিত্যে বাঙালি পেয়েছে নিজস্ব পরিচয়, আত্মদর্শন ও সৌন্দর্যের এক চিরন্তন সুর। কবিগুরুর কবিতা, গান, নাটক কিংবা দর্শন- সবকিছুতেই আজকের পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক বার্তা নিহিত রয়েছে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী কোনো নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের দিন। এই দিনে কেবল কবিকে স্মরণ নয়, বরং তার সৃষ্টিকে পাঠ, ভাবনা ও চর্চার মাধ্যমে নিজের জীবন ও সমাজকে আলোকিত করার এক সুযোগ। প্রতিটি প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ যেন এক নিত্যনতুন ব্যাখ্যার সূচনা- তার সাহিত্য আমাদের পাঠে, চর্চায় ও চিন্তায় বেঁচে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিকে যেমন কাব্যের পুষ্পবনে আমাদের মুগ্ধ করেন, তেমনি মানবতাবোধের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলেন। তার জন্মদিনে আমাদের শপথ হোক- কবিগুরুর চিন্তা, দর্শন ও সৃষ্টির সত্যসন্ধানী আলোকে নিজেদের আলোকিত করি এবং সমাজকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন করে তুলি। কারণ, তিনি আমাদের বলে গেছেন-

‘জীবন-পথে জীবন-যাত্রার

হোক না সে কঠিন, হোক না সে কঠোর,

তবু থাকুক সৌন্দর্য, থাকুক প্রেম-

থাকুক মানুষ হয়ে ওঠার স্পৃহা।’

শিক্ষার্থী,বাংলা বিভাগ

ঢাকা কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত