অসুস্থ পশুর মাংস খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পশু কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে ভোক্তাও তাতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই অমৃতের স্বাদ আশা করে কেউ যেন বিষ পান না করেন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব থেকেই দেশে প্রণীত হয়েছে পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণের আইন। ২০১১ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী কোনো পশু জবাইয়ের আগে ও পরে একজন ভেটেরিনারি সার্জন দিয়ে সংশ্লিষ্ট পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তার দেয়া সনদের ওপর ভিত্তি করেই জবাইকৃত পশুর মাংস খাওয়ার উপযুক্ততা নিশ্চিত হবে। অথচ এই আইন মানার বালাই নেই কোথাও। কোনো বিক্রয়কেন্দ্রেই মানা হয় না আইনের এই বিধান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীর সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত বাজারেও আইনটি যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ৩১ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশের ‘আইনে আছে বাজারে নেই মাংসের ‘ফিটনেস’ সনদ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগও দায়িত্ব পালনে উদাসীন। ফলে কোনো নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই করা পশুর মাংস গছিয়ে দিচ্ছেন ভোক্তাদের। ফলে ক্রেতার পক্ষে জানার সুযোগ থাকছে না পশুটি রোগাক্রান্ত কি না।
কিন্তু নিরাপদ খাদ্য ও নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ তো মানুষের মৌলিক অধিকার। ভাবতে অবাক লাগে, অথচ সেই অধিকার থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। যা প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দেয় সবচেয়ে বেশি শোনা প্রবাদ- কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। সরকারি কাজের হিসাবে গোলমালের প্রেক্ষাপটে জন্ম প্রবাদটি আজকের ব্যবহারিক জীবনেও কী ভীষণভাবে জড়িয়ে, তা প্রতি পদেই উপলব্ধি করায়। স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়াই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে পশু জবাই ও মাংস বিক্রির উদাহরণ কোনোভাবেই স্বস্তির নয়। তা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনকও বটে। আমরা জানি, নিরাপদ খাদ্য আইনের ৩৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য বা মৎস্যপণ্য অথবা রোগাক্রান্ত বা মৃত পশুপাখির মাংস, দুগ্ধ বা ডিম দ্বারা কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ প্রস্তুত, সংরক্ষণ বা বিক্রয় করতে পারবেন না। প্রথমবার এ অপরাধ করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন থেকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগের কথা জানা যায় না। আইনি দায়বদ্ধতার বিষয়টি যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। অথচ স্বাস্থ্যকর খাবার মানুষের কাছে সহজলভ্য করাও তো সরকারের একটি দায়িত্ব।
আমরা মনে করি, আইন প্রয়োগের বেলায় কর্তৃপক্ষকে যেমন আন্তরিক হতে হবে, তেমনি ভোক্তাকেও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। প্যাকেট খাবারের মোড়কের ওপরের তথ্যাদি দেখে যেমন আমরা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেই, একইভাবে প্রাণিজ মাংসের বেলাতেও ফিটনেস সিলসহ ভেটেরিনারি সার্জনের সনদ দেখে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজারজাতকৃত খাবারের প্যাকেটে যেমন নাম, দাম ও উপাদানের কথা লেখা থাকে, বিক্রির জন্য রাখা মাংসের গায়ে তা থাকে না। অথচ বিক্রির জন্য রাখা মাংসের গায়ে ‘ফিটনেস’ সিল থাকাও বাধ্যতামূলক। প্যাকেটজাত খাবারের গায়ের তথ্যগুলো যেমন দৃশ্যমান করানোর আইনি বাধ্যবাধকতা ও দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি প্রাণিজ মাংসের বেলাতেও। কিন্তু প্যাকেটজাত খাবারের বিষয়ে নিয়মিত তদারকি থাকলেও প্রাণিজ মাংসের বেলায় তা নেই। শুভংকরের ফাঁকি এখানেই দেয়া হয়। যার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।
সংক্রামকসহ নানারকম অসংক্রামক রোগ থেকে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে যে কোনো ধরনের উদাসীনতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিপদ। উন্নত দেশগুলোতে খাবারের কুফল বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, প্রতিকারের নানা প্রচেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নে বা জনসচেতনা তৈরির কাজ এখনও প্রায় কিছুই হয়নি। যে খাবারটি মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ এবং যা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিরই কারণ নয়, জনস্বাস্থ্যের উপরেও যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে- সেই খাবার থেকে মানুষকে দূরে সরাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সতর্কতামূলক প্রচারণা। যা মানুষের মনে প্রভাব ফেলবে এবং আইন অমান্যকারীকে বাধ্য করবে আইন মানতে। সেইসঙ্গে আমরা শুধু আইন প্রণয়নই নয়, আইন প্রয়োগ করার পরিকাঠামো নিশ্চিত করার জন্যও বলি। পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার যে বিধান রয়েছে, তা কেন বাস্তবায়িত হয় না, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে পশু জবাই ও মাংস বিক্রি বন্ধে যে তদারকির কথা রয়েছে, যাদের দেখভালের দায়িত্ব তারা কেন তা পারছেন না, তা যেমন খতিয়ে দেখতে হবে। তেমনি যেখানে ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও পরিদর্শকের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত যেসব জবাইখানা রয়েছে, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করার সঙ্গে নতুন জবাইখানার ঘাটতিও পূরণ করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের সচেতনতাই পারবে আইনকে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করতে। শুধু আইন প্রণয়ন করেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং তা কার্যকর করাও সরকারের দায়িত্ব।