ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সংবাদের অন্তরালে

ঈশিতা ইমু
সংবাদের অন্তরালে

প্রতিদিন সকালে যখন আমরা হাতে পত্রিকা তুলে নিই, কিংবা অনলাইনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিই, তখন আমাদের সামনে একগুচ্ছ খবর হাজির হয়। আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবন, দুর্নীতিতে ডুবে থাকা কর্মকর্তা, নিখোঁজ শিশু, ফুটবল মাঠে জয়ের উল্লাস কিংবা রাজনীতির প্রজ্ঞাবিহীন দাঙ্গা সব মিলিয়ে খবরের কাগজ যেন প্রতিদিন একটি নতুন উপন্যাসের প্রথম খণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা যা দেখি, তা কি আসলেই সম্পূর্ণ সত্য? নাকি ওই প্রতিটি লাইনের পেছনে লুকিয়ে থাকে আরেকটি অদৃশ্য কাহিনি- একটি ‘সংবাদের অন্তরালের’ গল্প?

আজ আমরা খোঁজ করব সেই অপ্রকাশিত, প্রান্তিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের, যা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া মানে সত্যকে অস্বীকার করা। সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল যতই নিরপেক্ষতার দাবিদার হোক না কেন, সংবাদ কখনওই একশ’ ভাগ নিরপেক্ষ নয়। কারণ সংবাদ গঠনের পেছনে থাকে নির্বাচন, মনোভাব এবং প্রায়ই গোপন স্বার্থ।

একটি উদাহরণ: খবরে মফস্বলের নাম নেই : ধরে নিই, দেশের এক গ্রামে হঠাৎ করেই বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এলাকার একমাত্র নলকূপ শুকিয়ে গেছে, আর বাকি পানির উৎস ধানখেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রভাবে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামবাসীরা অসুস্থ হচ্ছে, শিশুরা ডায়রিয়ায় ভুগছে, মা-বাবারা দিশাহারা। শুধু জলসঙ্কট নয়, পল্লির স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, গ্রামে ডাক্তার না থাকা, কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া এসব খবর জাতীয় পত্রিকার একটি পাতায়ও নেই। কেন নেই? কারণ এসব গল্পে ‘নাটকীয়তা’ নেই, ‘ব্রেকিং নিউজ’ নেই, ‘ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা’ নেই। সংবাদ এখন ‘রেটিংস’ এবং ‘ট্রেন্ডিং’য়ের যুগে পা রেখেছে। শহরের ধনী মানুষদের আগ্রহ জাগায় না এক গরিব গ্রামবাসীর পানির কষ্ট। তারা চায় উত্তেজনা, তারা চায় ঘটনা- হাইকোর্টের রায়, নায়ক-নায়িকার বিবাহবিচ্ছেদ, কিংবা রাজনীতিকদের বাদানুবাদ। আর সংবাদমাধ্যমও তাদের চাহিদামাফিক গল্প সাজিয়ে দেয়। অথচ এই গ্রামটির সমস্যা হয়তো আরও ভয়াবহ, আরও গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ যেখানে বাজারনির্ভর, সেখানে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ নিঃশব্দ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে যৌন নিপীড়নের মতো স্পর্শকাতর ঘটনা, কিন্তু এর একটিও যদি ভুক্তভোগী ‘পরিচিত’ না হন বা ঘটনাটি যদি রাজধানীর বাইরের কোনো অঞ্চলে ঘটে থাকে, তবে তা সংবাদপত্রের পাতায় ঠাঁই পায় না। এক্ষেত্রে সংবাদ হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের সামাজিক সেন্সরশিপের শিকার। বলা হয়ে থাকে, ‘এতে পাঠকের আগ্রহ নেই’, ‘মার্কেটিং ভ্যালু নেই’, কিংবা ‘রাজনৈতিক চাপ আছে’। এই ধরনের নির্বাচিত নীরবতাই আসলে আরও বড় অপরাধ। কারণ মিডিয়া শুধু যে প্রতিবেদন করে তা-ই নয়, তারা অনেকসময় প্রতিবেদন না করেও সমাজকে প্রভাবিত করে। যে ঘটনাগুলো আলোচনায় আসে না, সেগুলোর ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। একে বলা যায় এক ধরনের ‘সংবাদী পর্দাদান’ নতুন এক সেন্সরশিপের রূপ। একই ঘটনা ধরে নিই, দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ কিন্তু ভাষা দুটো এক নয়। যদি প্রথম দলটি ক্ষমতাসীন হয়, তবে বলা হয়, ‘বিরোধীদের উসকানিতে সংঘর্ষ’। আর যদি তারা বিরোধী হয়, তখন বলা হয়, ‘দলটির উগ্র কর্মীদের সহিংস আক্রমণ’। এখানেই সংবাদ হয়ে ওঠে একটি প্রপাগান্ডার হাতিয়ার। এই ধরনের শব্দচয়ন এবং শিরোনাম নির্ধারণ আসলে জনগণের মনোভাব গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখে। মানুষ আসল ঘটনা জানে না, তারা জানে সংবাদমাধ্যমের দেয়া ব্যাখ্যা। ফলে, সংবাদ হয়ে ওঠে এক ধরনের বাস্তবতা নির্মাণের কারখানা। অনেক সময় সংবাদের ধারা এমনভাবে সাজানো হয় যেন তা একেবারে নাটকীয় শিরোনামে রূপ নেয়। ধরুন, কোনো নামকরা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। সেই সংবাদ ছাপা হয় ‘শীর্ষ ধনীর বিপর্যয়’, ‘জমজমাট তদন্ত’, ‘গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সক্রিয়’ ইত্যাদি নাটকীয় ভঙ্গিমায়। পাঠক তখন সংবাদকে অনুসন্ধান হিসেবে না দেখে বিনোদনের চোখে দেখে। ফলাফল? আসল প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়- কেন তদন্ত হচ্ছে না কীভাবে টাকা পাচার হলো, কোন নীতির ফাঁক গলে এই অপরাধ সম্ভব হলো? সংবাদমাধ্যমগুলো এখানে আর সত্যের অনুসন্ধান করছে না, তারা গল্প বলছে। এক ধরনের scripted journalism -এর যুগে ঢুকে পড়েছি আমরা, যেখানে সাংবাদিক নয়, পরিচালকের মতো কেউ সংবাদ পরিচালনা করেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গোপন পৃষ্ঠপোষকতা ও বিজ্ঞাপনদাতার ছায়া। বিজ্ঞাপনদাতা হলো বর্তমান গণমাধ্যমের আর্থিক মেরুদণ্ড। আপনি যদি কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন যদি পত্রিকায় ছাপা হয়, তাহলে সেই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আবার অনেক সময় সাংবাদিককে ‘নরম’ ভাষা ব্যবহার করতে বলা হয়।

এমন উদাহরণ আছে, বহুজাতিক কোম্পানির বিষাক্ত পণ্য নিয়ে গবেষণায় বিপজ্জনক তথ্য উঠে আসলেও, সেই রিপোর্ট ‘ভদ্রভাবে’ প্রকাশ করা হয়, অথবা আদৌ প্রকাশ পায় না। তাই সংবাদ হয়ে দাঁড়ায় একরকম ‘নির্বাচিত বাস্তবতা’, যা গণমাধ্যমের আর্থিক নির্ভরতার ওপর নির্ভরশীল। এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মানুষ সংবাদ খুঁজে নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ এবং ইউটিউব চ্যানেল- এসব এখন ‘বিকল্প সংবাদপত্র’ হয়ে উঠেছে। অনেক সময় গ্রামের একজন তরুণ, মোবাইল হাতে তুলে, ঘটনার ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করছেন। তা ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাল হয়ে। তবে এখানেও বিপদ আছে। ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা, আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া একদিকে বিকল্প কণ্ঠস্বর তৈরি করলেও, অপরদিকে ভুল তথ্যের বিস্তারও বাড়িয়েছে। এই পুরো প্রেক্ষাপটে, প্রশ্ন উঠতেই পারে- সংবাদপাঠক হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী? আমরা কি কেবল মাত্র ভোক্তা, না কি সচেতন নাগরিক? যদি আমরা প্রতিটি সংবাদকে যাচাই না করি, ব্যাখ্যা না বুঝি, উৎস নিয়ে প্রশ্ন না তুলি- তাহলে সংবাদমাধ্যমগুলো কেবল বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে, কিন্তু সমাজের সত্য খুঁজে পাওয়ার কাজটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। মিডিয়া যা দেখায়, তা সব সময় পুরোটা নয়। অনেক সময় সেটি সাজানো, বাছাই করা, কখনও কখনও উদ্দেশ্যমূলক। কোন খবর গুরুত্ব পাবে, কোনটি চাপা পড়বে, সেটি নির্ধারণ করে কেউ কেউ। আমরা দেখি ঘটনাগুলো, কিন্তু সত্যটিকে অনেক সময়ই পাই না।

তাই প্রয়োজন একটুখানি থেমে দেখা, শোনা ও বোঝার চেষ্টা। সংবাদের পেছনের সেই মানুষগুলোকে অনুভব করা, যারা কাগজের পাতায় নেই, ক্যামেরার ফ্রেমে নেই, কিন্তু জীবনের ভাঙাচোরা কাহিনি নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে আছে। সংবাদের অন্তরালে আছে এক অন্যরকম দেশ- যেটা জানা দরকার, বোঝা দরকার, বদলানো দরকার। প্রতিটি পাঠকের উচিত, একাধিক উৎস থেকে সংবাদ পড়া, প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ দেখা এবং প্রশ্ন তোলা। কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ, যখন পাঠক নিজেও চিন্তাশীল এবং অনুসন্ধিৎসু। সংবাদ কেবল একগুচ্ছ তথ্য নয়। এটি একটি সমাজের, একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রতিচ্ছবির আড়ালেও থাকে অন্ধকার, থাকে অপ্রকাশিত কাহিনি। সেই কাহিনি অনুসন্ধান করাই সাংবাদিকতার মূল ব্রত হওয়া উচিত। কিন্তু যখন তা ব্যর্থ হয়, তখন আমাদেরই সেই আলো খুঁজে নিতে হয়।

সংবাদের অন্তরালে যে কাহিনিগুলো লুকিয়ে থাকে, তার খোঁজ আমরা যদি না রাখি, তবে একদিন সত্য ও মিথ্যার ব্যবধানই মুছে যাবে। সংবাদ কেবল তথ্যের সংকলন নয়, বরং তা একটি সমাজ, একটি জাতির চেতনার প্রতিফলন। আর সেই প্রতিফলন যেন বিকৃত না হয়, সেজন্য দরকার পেশাদার সাংবাদিকতার পাশাপাশি সচেতন পাঠকসমাজ। সংবাদের অন্তরালে যে অজানা, অব্যক্ত বাস্তবতাগুলো লুকিয়ে থাকে, তা যদি আমরা না জানি, তবে হয়তো সমাজের গঠনপ্রক্রিয়াও হয়ে পড়বে একপাক্ষিক, বিভ্রান্তিকর। সত্য সর্বদা স্পষ্ট নয় তাকে খুঁজে নিতে হয়। আর সে অনুসন্ধানেই আমরা এগিয়ে যাই, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত