আজ শনিবার বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস ২০২৫। বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে ১৭ মে দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলছে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর এই সমস্যায় সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়।
বিশ্বজুড়ে উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত এবং আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন।
কখন বুঝবেন উচ্চ রক্তচাপ? : ব্লাড প্রেসারের দুটি রিডিং, যেমন ১২০/৮০। প্রথমটি সিস্টোলিক। হার্ট যখন স্পন্দিত হয় বা সংকুচিত হয়, তখন রক্তনালিতে যে চাপ তা হলো ‘সিস্টোলিক রক্তচাপ’। আর নিচেরটি হলো ‘ডায়াস্টোলিক’। পর পর দুই দিন ১৪০/৯০ পেলে তা হলো উচ্চ রক্তচাপ।
সাধারণভাবে ১২০/৮৯ মিমি পারদ হলো স্বাভাবিক রক্তচাপ। হঠাৎ করেই রক্তচাপ বেড়ে তা প্রাণ সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিজ্ঞানীরা একে বলেন, নীরব ঘাতক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বছরে এক কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়।
এই সংখ্যা অনেক সংক্রামক রোগের চেয়ে বেশি। দেশে ৬৮ শতাংশ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক রোগ। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মৃত্যুর হার ৩৩ শতাংশ। এটি ২০২২ সালের হিসাব। চলতি বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী দেশে পাঁচজনের মধ্যে একজনের রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে মাত্র ১৪ শতাংশ রোগী একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন। ২০২৪ সালে আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, শহুরে জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
হার্ট সুস্থ রাখতে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং সুস্থ জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। বাংলা কথা রক্ত চাপ। কিন্তু ইংরেজিটাই পরিচিতি বলে বাংলা বুঝি না। এই ব্লাড প্রেসার নামক রোগটি আজকাল ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ, করেছে। যে কোনো রোগীই ডাক্তার খানায় গিয়ে বলে থাকেন, ডাক্তার সাহেব, আমার প্রেসার টা একটু দেখেন তো। এটির সাধারণত: শহরের ধনীও বিলাসী ব্যক্তিদের রোগ। খেটে খাওয়া বা দিন মজুর মানুষের এরোগ হয় না। আর হলেও তা উচ্চ রক্তচাপ হয় না, নিম্ন চাপেই থাকে। এখন বুঝতে হবে এই রক্ত চাপটি কি? উচ্চ রক্তচাপ ইহার ভাবী ফল অত্যন্তন ভয়ানক, আশঙ্কাজনক। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্বারা যে শক্তিচালিত হয়, ইহাই উচ্চ রক্তচাপ।
ব্লাড প্রেসার অন্য রোগের লক্ষণ : কোন সময় রক্তচাপ অত্যন্ত বাড়িয়াও যায়, কোন সময় কমিয়া যায়, শির পীড়া, মাথা ঘুরা, বুকে চাপ বোধ, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ভার বোধ, শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির মতো অবস্থা নিদ্রা কমিয়া যায়, মাঝে মাঝে নাসিকা থেকে রক্ত পড়ে। আরও অনেক লক্ষণ আসতে পারে, মাথায় রক্ত উঠিয়া অস্থিরতা, চিলিক মারা, মাথাব্যথা, চোখ, মুখ লাল তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কিংবা সংজ্ঞাহীন অবস্থা হৎপি- সংকোচণ্ডপ্রসারণের ফলে রক্তনালীর মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। রক্তনালীর মাধ্যমে প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্ত ধমনীর গায়ে যে চাপ সৃষ্টি করে, তাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপের দু’টি মান থাকে সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক। হৃৎপিণ্ড সংকোচনের সময় ব্লাড প্রেসার বেশি হয়। হৃৎসংকোচনের ফলে ধমনীর গায়ে সৃষ্ট এই রক্তচাপকে ‘সিস্টোলিক’ ব্লাড প্রেসার বলে। অপর পক্ষে, হৃৎপিণ্ড যখন প্রসারিত হয়, তখন ধমনীর গায়ে রক্তের চাপ পড়ে কম।
উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ : ১. শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায়। যেসব হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায়, তাদের বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ)। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে কিডনির অসুখ, এড্রেনাল গ্লান্ডের অসুখ ইত্যাদি।
২. শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায় না। কারণ না জানা এই উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয়, এসেনসিয়াল হাইপারটেনশন।
১৯৩০-১৯৪০ সালের দিকে কিছু প্রভাবশালী চিকিৎসক বিশ্বাস ও প্রচার করতেন যে, সরু ও অনমনীয় রক্তনালীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত করতে ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি অপরিহার্য, বিশেষত বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। তারা এটাও বলতেন, এ ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধিতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে না। অনেক সময় পেরিয়েছে, অনেক সমীক্ষা ও গবেষণা হয়েছে; আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে, ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি অপরিহার্য নয় বা তা বয়োবৃদ্ধির অত্যাবশ্যকীয় পরিণতি নয় বরং ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধিতে রক্ত সংবহনতন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। আগের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু নামটা এখনও রয়ে গেছে- অপরিহার্য উচ্চ রক্তচাপ। এসেনসিয়াল হাইপারটেনশন বা অপরিহার্য উচ্চ রক্তচাপের সঠিক কারণ জানা না গেলেও জানা গেছে, কিছু প্রভাবকের কথা যা উচ্চ ব্লাড প্রেসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলোকে বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবক।
উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবকগুলো হলো- বংশগত ধারা, বয়স, গোত্র, কম শারীরিক পরিশ্রমযুক্ত জীবনযাত্রা, মানসিক চাপ, ধূমপান, মদ্যপান, মেদবাহুল্য ইত্যাদি।
উচ্চ রক্তচাপের বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ : উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের এর ঝুঁকি থাকে।
ধূমপান : ধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদাঞগহর্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ : খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ বেড়ে যায়।
অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা : যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদ্যন্ত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন ও ডুবো তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়ে। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
ডায়াবেটিস : বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিসের রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এ ছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা : অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণে মস্তিষ্কে সমস্যা এবং স্ট্রোক : মানুষের শরীরে উচ্চ রক্তচাপের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত ??ও অক্সিজেন সরবরাহকারী ধমনী ফেটে যাওয়া বা ব্লকের সম্ভাবনা থাকে, যার ফলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। মস্তিষ্কের কোষগুলো স্ট্রোক হওয়ার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। স্ট্রোক মানুষের বাকশক্তি, নড়াচড়া করার ক্ষমতা এবং অন্যান্য কার্যকলাপের ব্যাপারেও অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে। স্ট্রোকের কারণে এমনকি আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে মাঝবয়সী ব্যাক্তিদের উচ্চ রক্তচাপের সাথে মস্তিস্কের কার্যকারিতা এবং ডিমেনশিয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ লক্ষ্য করা গেছে।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে পরামর্শ : জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমানো সম্ভব নয়। তবে এ রকম ক্ষেত্রে যেসব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে : খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা : কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ। অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন- সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো। আটার রুটি এবং সুজিজাতীয় খাবার পরিমাণ মতো খাওয়া ভালো।
লবণ নিয়ন্ত্রণ : তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। মদ্যপান: মদ্যপান পরিহার করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম: সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি। ধূমপান বর্জন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা : নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।