আধুনিক বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বা বইনির্ভর শিক্ষা এখন আর যথেষ্ট নয়। বর্তমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এর প্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শিক্ষাপদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীকে এমনভাবে প্রস্তুত করে, যাতে সে সরাসরি কর্মক্ষেত্রে অংশ নিতে সক্ষম হয়। কারিগরি শিক্ষা হলো এমন একটি শাখা, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু ট্রেড বা পেশাভিত্তিক বিষয়ের ওপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ লাভ করে। যেমন- কম্পিউটার, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, মেকানিক্যাল, টেক্সটাইল, ওয়েল্ডিং, ফুড প্রসেসিং এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। এসব ট্রেডের আওতায় শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করে এবং বাস্তবজীবনে সেগুলোর প্রয়োগ করতে শেখে।
কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা শিক্ষার্থীদের দ্রুত কর্মসংস্থানের পথে এগিয়ে নেয়। কারণ এই শিক্ষা অর্জনের পর একজন শিক্ষার্থী শুধু একাডেমিকভাবে যোগ্য নয়, বরং সে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বাস্তব কাজ করার জন্যও প্রস্তুত থাকে। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমান বিশ্বে দক্ষ শ্রমিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যা কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কারিগরি শিক্ষার আরেকটি বড় সুবিধা হলো- এটি উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। একজন শিক্ষার্থী যিনি কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেন, তিনি চাইলে নিজেই একটি ছোট বা মাঝারি পরিসরের ব্যবসা শুরু করতে পারেন। যেমন- কম্পিউটার সার্ভিসিং, ইলেকট্রিক মেরামত, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ বা মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার ইত্যাদি। এতে তিনি নিজের জন্য আয় নিশ্চিত করতে পারেন, পাশাপাশি অন্যান্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। এতে জাতীয় অর্থনীতির চাকা আরও সচল হয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কারিগরি শিক্ষার ব্যয় সাধারণ শিক্ষার তুলনায় অনেকটা কম হয়ে থাকে। বিশেষ করে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট কিংবা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তুলনামূলক কম খরচে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে উপবৃত্তি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণকালীন ভাতা এবং বিনামূল্যে বই ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের সুবিধাও। ফলে নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাও সহজেই এই শিক্ষার আওতায় আসতে পারে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পায়। তাছাড়া বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বিভাগের অ্যাসিট প্রজেক্টের আওতায় শিক্ষার্থীদের সরকারি অর্থয়ানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরের সুযোগ রয়েছে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেশের বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালগুলোর কার্যকম সরাসরি দেখে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে পারবে।
কারিগরি শিক্ষার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো- প্র্যাকটিক্যাল শেখার সুযোগ। এখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই মুখস্থ করে না, বরং ল্যাব, ওয়ার্কশপ এবং বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরাসরি হাতে-কলমে কাজ শেখে। এতে তাদের দক্ষতা বাস্তবভিত্তিক হয় এবং তারা কর্মক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে পারফর্ম করতে সক্ষম হয়। এই ধরনের শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীকে কেবল একজন চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং একজন দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে গড়ে তোলে। অনেকের ধারণা থাকে যে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কারিগরি শিক্ষার পর বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগও রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন, কারিগরি শিক্ষার ভিত্তিতে স্কলারশিপ দিচ্ছে। তাই এই শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষার পথে বাধা হিসেবে না দেখে, বরং একটি ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কারিগরি শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কারণ দক্ষ জনগোষ্ঠী ছাড়া একটি দেশ টেকসই উন্নয়ন ও শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে না।
বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগে এখন প্রচুর পরিমাণে দক্ষ কারিগরি জনবল প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাই একমাত্র ভরসা। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও দক্ষতার চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং, সাইবার সিকিউরিটি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন, অটোমেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব ক্ষেত্রেও কারিগরি শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
আরেকটি বাস্তব দিক হলো- অনেক শিক্ষার্থী যারা এসএসসি বা এইচএসসিতে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেনি, তারা সাধারণ শিক্ষার মূলধারায় টিকে থাকতে হিমশিম খায়। কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় এসে তারা বাস্তবভিত্তিক ও ফলপ্রসূ শিক্ষার সুযোগ পায়। এতে তারা একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, অন্যদিকে তাদের ক্যারিয়ারের জন্য একটি কার্যকর পথও তৈরি হয়। সব দিক বিবেচনায় বলা যায়, কারিগরি শিক্ষা কেবল একটি ডিগ্রি নয়, এটি একটি দক্ষতা অর্জনের পথ, একটি আত্মনির্ভরশীল জীবনের সূচনা এবং একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার মেধা ও সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তাই যারা এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন, তাদের উচিত সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য।
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ