ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

যখন খাবারও যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়

রায়হান আহমেদ তপাদার
যখন খাবারও যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়

আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটা চলছে এখনও। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। যদিও সংঘাত বন্ধে শান্তির ফরমুলা হিসেবে বিভিন্ন সময় দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে। সে সময় বলা হয়, ইসরাইল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি। এর ধারাবাহিকতাতেই হয় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। কিন্তু একটা সময়ে এসে ঠিকই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন উভয়পক্ষই দুই রাষ্ট্র সমাধানে ঐক্যমত হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে হলো? এবং পরে কেন আবার ব্যর্থও হলো সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। যেটা অসলো অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। এটা গঠনের সময়সীমা ছিল পাঁচ বছর। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করে নেয় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়। অসলোতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে তার কোনো সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। আরব বিশ্বের পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও পশ্চিমা দেশগুলো এখনো ইসরাইলের অব্যাহত হামলা চালানোর অনড় অবস্থানের পক্ষে। এদিকে গাজায় খাবার ও পানির তীব্র হাহাকার চলছে। আগে থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা গাজার বাসিন্দাদের অনেকের এখন অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে। জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজার অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। সামান্য ত্রাণসহায়তায় নির্ভরশীল তারা। দাতব্য সংস্থাগুলোর দেওয়া খাবারের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে গাজাজুড়ে। সংস্থাগুলো বলছে, তাদের কাছে যে খাবার আছে, তা দিয়ে এতসংখ্যক মানুষের চাহিদা মিটছে না। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, গাজাবাসীর বিরুদ্ধে অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে খাদ্য বন্ধ করে দেওয়াকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করতে চেয়েছে, তখন সেটার বাস্তবায়নও হয়েছে। মিশর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি, জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি এমনকি সাম্প্রতিককালে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের সবগুলোর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা আছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ আছে কি না, এমন প্রশ্নে থেকেই যাচ্ছে। দুই যুগ আগে নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকার চোখ অসলো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন থেকে সরে যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। সেটা শেষ হলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইরান, রাশিয়া, চীন নিয়ে। কিন্তু এখন আমেরিকাকে আবারো মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় হতে হচ্ছে। কারণ এখানে অবহেলা করলে এর ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে, কিছু সময় পর পর সংঘাত সামনে আসবে। আমেরিকা শান্তির উদোগ নিলে হয়তো সেটা আশা দেখাতে পারে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কার্যক্রম নিয়ে বলতে গিয়ে লজ্জাজনক শব্দই ব্যবহার করেছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’য়ার। ইসরায়েল যেন অবশ্যই গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ আইসিজের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যাওয়ার ঠিক আগে আবারও গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করার দুই মাস পর জাতিসংঘ এ প্রশ্ন তুলল। এখন সরবরাহ শূন্য হওয়ার পথে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, হাজার হাজার শিশু ইতোমধ্যে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। সা’য়ারের অভিযোগ, ইসরায়েলকে অন্যায্যভাবে নিশানা বানানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়েছে। এতে বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে থাকার ব্যাপার জোরালোভাবে উঠে এসেছে। গত গ্রীষ্মে অতি ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ মন্তব্য করেছিলেন, ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের নৃশংসতাকালে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে জনগণকে অনাহারে রাখা ন্যায্য ও নৈতিক হতে পারে, যদিও বিশ্বের কেউ আমাদের সে অনুমতি দেবে না। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গত মাসে বলেছিলেন, তাদের ‘নীতি স্পষ্ট: গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশ করবে না।’অতি ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির জোর দিয়ে বলেছেন, জিম্মিদের মুক্ত না করা পর্যন্ত এক গ্রাম খাবার বা কোনো সাহায্য প্রবেশের সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় ৫২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। ইউনিসেফ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে শিশুই ১৫ হাজার। মার্চে নতুন করে ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বোমা হামলায় যেমন মানুষের মৃত্যু ঘটে, তেমনি অনাহারে মানুষ মারা যায়। কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধের আগের তুলনায় ৩০ গুণ দামে আটা কিনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। সহায়তা সামগ্রীর গুদামগুলো খালি পড়ে আছে। সরবরাহ শেষ হওয়ায় এক মাস আগে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজনীয় কমিউনিটি বা গোত্রভিত্তিক রান্নাঘরগুলোও বন্ধ। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সহায়তা পাঠানোর ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে অনুমতি দিতে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইসিজেকে বলেছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য এটি করা তার বাধ্যবাধকতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আইন কিন্তু বলছে, জেনেভা কনভেনশনের অধীনে দখলদার শক্তির একটি অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য হলো অভাবী জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সরবরাহের অনুমতি দেওয়া। ইসরায়েল আগামী সপ্তাহগুলোতে সাহায্য বিতরণ পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সেটি হবে আমূল পরিবর্তিত নতুন এক পদ্ধতির মাধ্যমে। তাদের দাবি, মানবিক প্রচেষ্টার জন্য অপরিহার্য জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থায় হামাসের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জাতিসংঘ ও অন্যরা অভিযোগটির তীব্র বিরোধিতা করেছে। পৃথক পরিবারে খাদ্য সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তাবিষয়ক ঠিকাদারদের বিকল্প প্রস্তাবটি এখন অকার্যকর এবং বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক আদালতগুলোকে আক্রমণ করছে, তখন যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশকে সেগুলো রক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। অবিলম্বে সাহায্য প্রদান পুনরায় চালু করার জন্য তাদের জোরালো চাপ দিতে হবে। এই আইসিজে মামলাটি লজ্জাজনকভাবে এখানে আনতে হলো। আরও লজ্জাজনক দিক হলো, এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাজার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিশু মরতে চেয়েছিল। এটাও লজ্জাজনক যে, এত বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে এবং আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষকে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটি আসলে ঘটতে দেওয়া হয়েছে। এটাও লজ্জাজনক। গাজায় অব্যাহত বোমাবর্ষণে ক্ষতির শিকার হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি, ওষুধ ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাজার হাসপাতাল। এতে করে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা বাস্তবায়ন করা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় খুবই কঠিন। কারণ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের ইহুদি বসতি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এটা ছিলো এক লাখ ২০ হাজার। গেলো তিন দশকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বেড়ে হয়েছে সাত লাখ। এছাড়া খোদ ইসরায়েলের আইন অনুযায়ীই অবৈধ এরকম ইহুদি বসতিও আছে। এরকম বসতি সম্প্রসারণ এবং ইসরায়েলের রাজনীতিতে এর প্রবল সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিও এখন আর ইসরায়েলের আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও হামাস এবং ফাতাহ দুই দলে বিভক্ত। এবং তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কথা বলা বা শান্তি প্রক্রিয়া এগুনোর মতো একক এবং বিশ্বস্ত নেতা নেই। তাহলে কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর সম্ভব নয়? ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক অবশ্য বলছেন, সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু ইসরাইল কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর চায়? লিটভ্যাক বলছেন, ইসরাইল সেটা চায় না। এখানে ইসরাইলের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হচ্ছে। তারা যেটাকে সমাধান মনে করে সেটা হচ্ছে, পরিস্থিতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। এমনকি জেরুজালেম নিয়েও দুইপক্ষ ছাড় দিলে ঐক্যমতে আসা সম্ভব। কিন্তু ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে এখন যে নতুন যুদ্ধাবস্থা, সেখানে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অচলাবস্থার পরিবর্তন কে করবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন গবেষকরা মনে করেন, এখানে আমেরিকাকেই আবার এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির উদ্যোগ নিলে সেটা সফল হতে পারে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত