রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট ছয়টি কমিশন গঠন হয়েছে অনেক আগেই। নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন সংস্কার, সংবিধান সংস্কার কমিশন- ছয়টি কমিশনের প্রধান বিশিষ্ট নাগরিকরা। শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক চাহিদার একটি হলেও এ নিয়ে কোনো কমিশন গঠনের ঘোষণা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে শিক্ষা সচেতন নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা কমিশন গঠনের যথেষ্ঠ উৎসুক্য রয়েছে। কারণ সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রতি রাষ্ট্রের উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নের কার্যক্রমের কথা চিন্তাও করা যায় না। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন জরুরি। বর্তমানে দেশের সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে গড়েছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতির ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা দিন দিন কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে নবম শ্রেণি। দশম শ্রেণিতে উঠে তাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অবস্থাও নড়বড়ে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। পলাশির প্রান্তরে ভাগ্যবিপর্যয়ের পর বাঙালি মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নের কোনো সুযোগ আসেনি। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার মাধ্যমে বাঙালির জন্য সে সুযোগ আসে। জাতিগত উন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই শিক্ষাকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপযোগী ও উন্নয়নমুখী করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের রিপোর্ট দাখিল করে। নতুন প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয় এই রিপোর্ট। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, কমিশন এদেশের কোটি কোটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে উল্টো পথে চলে। তারা শিক্ষানীতিতে ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও ইসলামের প্রতি অশ্রদ্ধা রেখে রিপোর্ট প্রণয়ন করে। মূলত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ইসলামি আদর্শবিরোধী নৈতিকতাহীন এক কালো শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে। যার দীঘল ছায়া বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমকে অন্ধকার করে রাখে। কুদরত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশের আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস প্রণয়নের জন্য প্রফেসর শামসুল হুদাকে প্রধান করে ১৯৭৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৫১ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে গঠিত এই জাতীয় কমিটি মার্চ মাসে এর কার্যক্রম শুরু করে। লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কমিটি দশটি সাব-কমিটি ও ২৭টি সাবজেক্ট কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯৭৬, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে সাত খণ্ডে এর সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করে। কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে একমুখী ও সমরূপ মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন এবং ১৯৮০ সালের স্কুল সেশন থেকে নবম শ্রেণি স্তরে এই পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করে। ১৯৭৮ সালে সরকার কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং শিক্ষার সমস্যাবলি নতুনভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে একটি উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় যাতে জনগণ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। রিপোর্টে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলিত কাঠামোকে তিনটি উপ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়, নিম্ন মাধ্যমিক তিন বছর, মাধ্যমিক দুই বছর এবং উচ্চ মাধ্যমিক দুই বছর।
এরপর ১৯৮৩ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু এই কমিশনের রিপোর্ট ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করেনি এবং তা বাস্তবায়নের কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্বিন্যাস ও উন্নয়নের উপায় পুনর্বিবেচনার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দিন আহমদকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। চেয়ারম্যানের নামানুসারে এটি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিতি লাভ করে। কমিশনের দুই সদস্যবিশিষ্ট দুটি দল উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন ও জাপান সফর করেন। এই কমিশন ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করে। ১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারিতে জারিকৃত এক আদেশের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এম শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। বাস্তবধর্মী, গণমুখী ও গতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে এই কমিটি কাজ শুরু করে।