মরুভূমির রুক্ষতা আর তীব্র তাপদাহের মাঝেও এক অদ্ভুত জীবন লুকিয়ে থাকে সান্ডা। এই সরীসৃপটি তার টিকে থাকার অদম্য ক্ষমতা, রহস্যময় আচরণ এবং পরিবেশের সঙ্গে চমৎকার অভিযোজনের জন্য পরিচিত। বালির ঢেউ খেলানো প্রান্তরে, পাথুরে ভূমিতে কিংবা ঝোপঝাড়ের আড়ালে এদের দেখা মেলে। সান্ডা শুধু একটি প্রাণী নয়, এটি মরুভূমির জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার জীবনকথা প্রকৃতিপ্রেমী ও বিজ্ঞানীদের কাছে আজও বিস্ময়ের উৎস।
সান্ডা মূলত টৎড়সধংঃুী গণের অন্তর্ভুক্ত টিকটিকিজাতীয় সরীসৃপ। এদের শরীরের গঠন বেশ মজবুত ও পেশিবহুল হয়, যা মরুভূমির কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এদের পুরু, কাঁটাযুক্ত লেজ। এই লেজ আত্মরক্ষার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিপদ দেখলে এরা লেজ দিয়ে সজোরে আঘাত করতে পারে। এছাড়াও, লেজে ফ্যাট সঞ্চিত থাকে যা দীর্ঘদিন খাদ্য ও জলের অভাব মেটাতে সাহায্য করে।
সান্ডার দেহের রঙ পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো হয়। সাধারণত বাদামি, ধূসর, হলুদ বা কমলা রঙের বিভিন্ন শেড দেখা যায়, যা তাদের শিকারি এবং শিকার উভয়ের চোখ ফাঁকি দিতে সাহায্য করে। এদের খাটো ও শক্তিশালী পা বালুর উপর দ্রুত চলতে এবং গর্ত খুঁড়তে উপযোগী। এদের নখর বেশ শক্ত হয়, যা মাটি আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করে। সান্ডারা মূলত তৃণভোজী প্রাণী। মরুভূমিতে জন্মানো বিভিন্ন প্রকার গুল্ম, লতাপাতা, ফল এবং বীজ এদের প্রধান খাদ্য। শক্তিশালী চোয়াল ও দাঁতের সাহায্যে এরা কঠিন উদ্ভিদ অংশও সহজে চিবিয়ে খেতে পারে। জলের অভাব এদের নিত্যসঙ্গী, তাই এরা খাদ্য থেকে এবং শরীরের অভ্যন্তরে বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জল সংগ্রহ করে। দিনের বেলায় যখন মরুভূমির তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন এরা নিজেদের তৈরি করা গর্তে আশ্রয় নেয়। এই গর্তগুলো দিনের বেলায় শীতল থাকে এবং রাতের ঠান্ডায় উষ্ণতা প্রদান করে।
সান্ডার প্রজনন প্রক্রিয়া ঋতুভিত্তিক। সাধারণত বসন্তকালে পুরুষ সান্ডারা সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকার অঙ্গভঙ্গি ও লড়াই করে থাকে। স্ত্রী সান্ডা বালুর মধ্যে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং সেগুলোকে বালু দিয়ে ঢেকে দেয়। ডিম পাড়ার পর স্ত্রী সান্ডা সাধারণত ডিমে তা দেয় না। পরিবেশের তাপে ডিম ফোটে এবং ছোট সান্ডারা নিজেরাই নিজেদের জীবন শুরু করে। সান্ডাদের জীবনযাত্রা বেশ ধীরস্থির। এরা সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করে এবং নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করে রাখে। পুরুষ সান্ডারা তাদের এলাকায় অন্য পুরুষ সান্ডাদের প্রবেশে বাধা দেয়। এদের শ্রবণশক্তি খুব ভালো না হলেও এরা মাটি ও বাতাসের কম্পন অনুভব করতে পারে, যা তাদের শিকারী প্রাণীর আগমন টের পেতে সাহায্য করে। বিভিন্ন অঞ্চলে সান্ডার বিভিন্ন প্রজাতি দেখা যায় এবং এদের আকার ও রঙের ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। কিছু প্রজাতি আকারে বেশ বড় হয়, লম্বায় প্রায় ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের জীবনকালও বেশ দীর্ঘ হয়, কোনো কোনো সান্ডা ২০ বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
তবে দুঃখের বিষয় হলো, আবাসস্থল ধ্বংস, চোরাচালান এবং মানুষের দ্বারা শিকারের কারণে অনেক প্রজাতির সান্ডা আজ হুমকির মুখে। এদের মাংস এবং চামড়ার জন্য অবৈধ শিকার এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও, মরুভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনও এদের জীবনযাত্রার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সান্ডা মরুভূমির বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা তৃণভোজী হওয়ায় উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং ছোট শিকারী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবেও কাজ করে। এদের সংরক্ষণ করা তাই অত্যন্ত জরুরি। এদের আবাসস্থল রক্ষা করা, চোরাচালান বন্ধ করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা এই রহস্যময় প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। সান্ডার জীবনকথা আমাদের শেখায় প্রকৃতির সাথে অভিযোজন এবং টিকে থাকার অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে। মরুভূমির বুকে এই নীরব প্রাণীরা প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি, যাদের রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এদের রহস্যময় জীবন যেন অনন্তকাল ধরে মরুভূমির বুকে টিকে থাকে এটাই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য।