ঢাকা বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

লোডশেডিং রোধে যা করণীয়

ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
লোডশেডিং রোধে যা করণীয়

যত গরম ঘনিয়ে আসছে, বিদ্যুৎ নিয়ে আলাপচারিতা বেড়ে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তায় অন্তত তিনটি আলোচনা চোখে পড়েছে, অবশ্য চোখের বাইরেও কম আলোচনা হচ্ছে না।

আবহাওয়ার সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যেমন ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, জলবায়ুর সঙ্গেও তেমনি ঘনিষ্ঠতা আছে। গরম কেমন পড়বে, তার ওপর নির্ভর করবে মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা। যদি গরম বেশি পড়ে, তাহলে এয়ারকুলার বা শীতাতপ যন্ত্রের বিপুল ব্যবহার আশা করা যায়। বেশি গরম অর্থ বেশি এসি, তার অর্থ বেশি বেশি বিদ্যুৎ- একদম ঐকিক সম্বন্ধ। জলবায়ুর সাথে সম্পর্কটা একটু ঘুরপথে।

বৈশ্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ জীবাশ্মণ্ডজ্বালানির উপর নির্ভর করে। জীবাশ্মণ্ডজ্বালানি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে, এই গ্যাস বাতাসের তাপ-ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে গ্রহকে উষ্ণ করে তোলে। এভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বেড়ে যায়।

এই উষ্ণায়ন যদি কমাতে বা সীমার মধ্যে রাখতে চান, তাহলে আপনাকে জীবাশ্মণ্ডজ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। অতএব, বিদ্যুৎ উৎপাদনে আপনাকে বিকল্প উৎসের খোঁজ করতে হবে। যেমন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার আপনার নিঃসরণকে কমিয়ে দেবে। কিন্তু এমন জ্বালানির শক্তি-ঘনত্ব বা এনার্জি ডেনসিটি অত্যন্ত কম। যখন বেশি বেশি ফ্যান চলবে, এসি চলবে, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। জোগান কম থাকলে তখন কাউকে কাউকে বঞ্চিত থাকতে হবে।

এত কম শক্তি-ঘনত্বের উৎস নিয়ে উৎপাতও কিন্তু কম নয়।

অথচ তুলনায় জীবাশ্মের শক্তি-ঘনত্ব অনেক বেশি, ফলে অল্পতেই চাহিদা মেটে, দ্রুত পরিবহন করা যায়, এক দেশ থেকে আরেক দেশে বয়ে নেওয়া যায়-পাইপে বা জাহাজে - কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। পারদের ওঠানামা, কাজেই, গ্রিড-অপারেটর এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে এটার অর্থ লোডশেডিং। যদি বৈদ্যুতিক লোড বেড়ে যায়, আর উৎপাদন সীমিত থাকে, তাহলে সব লোডকে তো আর সরবরাহ করা যাবে না, তখন কিছু সংযুক্ত লোডকে ছেঁটে ফেলতে হয়, কমিয়ে দিতে হয়, একেই ‘লোডকে শেড করা’ বলে।

বেশি গরম পড়লেও তা-ই হয়। যখন বেশি বেশি ফ্যান চলবে, এসি চলবে, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। জোগান কম থাকলে তখন কাউকে কাউকে বঞ্চিত থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রাক্কলনে এই গ্রীষ্মে লোড বাড়বে ১৮ হাজার থেকে সাড়ে-১৮ হাজার মেগাওয়াট বলে জানা যাচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন দফতর এই প্রাক্কলন করেছেন। এখন এই পুরো লোডকে সরবরাহ করা অসম্ভব নয়, খুবই সম্ভব। আপনাকে তখন সব বিদ্যুৎ-উৎপাদন কেন্দ্রগুলো একত্রে চালাতে হবে। সেটাও কি অসম্ভব? মোটেই না।

আপনি জ্বালানি দিলেই তারা চলবে, যদি সবগুলো ঠিক থাকে। এমন হতেই পারে কোনো একটি কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলো, তখন সেটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। ত্রুটি মেরামত করে সেগুলো আবার উৎপাদনে যুক্ত হবে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি (প্রাইমারি ফুয়েল) গ্যাস ও তেল।

কিছুটা কয়লা। খুবই সামান্য পানি-বিদ্যুৎ ও সোলার। ফলে আপনি জ্বালানি মজুদ রাখবেন, আর বিদ্যুৎ তরতরিয়ে তার বেয়ে আপনার গৃহকোণে পৌঁছে যাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু চাইলেই আপনি তা করবেন কি না, বা যেমন চাই তা-ই পাওয়া যাবে কিনা, কিংবা এগুলো বাস্তবসম্মত কি না- সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, এই জ্বালানি কোথায় মিলবে।

গ্যাস আমাদের প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসলেও তা হাল-আমলে সীমিত হয়ে এসেছে। ফলে অনেকখানি তরলায়িত গ্যাস আমাদের কিনতে হচ্ছে। জেনারেটর চালানোর তেল আমাদের কিনতে হয়। তেল বা গ্যাস বিদেশ থেকে কিনতে হলে ডলার খরচ করতে হবে। অর্থাৎ, ফেল কড়ি মাখো তেল। যত এসি, তত ডলার। এখন ডলার থাকলে তো সমস্যা ছিল না, সমস্যাটা ওইটাই।

বেশি ডলার চলে গেলে কোষাগার খালি হয়ে যাবে। তাছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় সেই ঘাটতি পূরণও অনেক কষ্টের ব্যাপার। তাহলে করণীয় কী? অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। পকেট বুঝে খরচ করতে হবে।

যেমন মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘অযাচিত ব্যয় কমিয়ে ও দুর্নীতির লাগাম টেনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে পুরোনো, অদক্ষ ও ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ ও সিস্টেম লস কমানো, ক্যাপাসিটি চার্জ কমানো, কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সস্তা জ্বালানি অগ্রাধিকার দেওয়া, পিডিবি ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যয় হ্রাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, সব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়াসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ (দেশ রূপান্তর, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)। এই পদক্ষেপ অনেকটা সতর্ক গৃহস্বামীর মতো - তিনি খুব সাবধানে পা ফেলছেন, মেপে খরচ করছেন, দিনে দুইবার আইসক্রিম চাইলেও খাচ্ছেন না, আত্মাকে সংবরণ করছেন, ফ্ল্যাটের দুই ঘরে দুইজন দুটি পাখা না চালিয়ে একঘরে দুইজন একটি পাখায় বাতাস খাচ্ছেন ইত্যাদি।

এটা একটি পরিপক্ব গৃহকর্তার উদাহরণ। গুড গভর্নেন্সও বটে। বাজে খরচ কমিয়ে, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সামান্য লোডশেডিং সহ্য করে বৃহত্তর লক্ষ্যে কাজ করা। একথা ঠিক আপনি চাইলেই তেল পুড়িয়ে দামি বিদ্যুৎ-সুবিধা অর্জনের চেয়ে আপনি কিছুটা কষ্ট করে খরচ ন্যূনতম রাখলেন। বিলাসিতায় গা না ভাসিয়ে আপনি সামলে চললেন। ফলে একই ঢিলে আপনি একাধিক পাখি মারতে পারলেন – আপনি সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দিলেন, দাম না বাড়িয়েই; আবার ভর্তুকিতেও হাত দেওয়া লাগল না, যতটুকু আছে ততটুকুই থাকুক।

ভর্তুকি ওঠানোর মুদ্রা তহবিলের চাপের মুখে এটা অত্যন্ত প্রাজ্ঞ পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়েছে। তারপরও যদি লোডশেডিং করতে হয়, তাহলে এটা হোমণ্ডম্যানেজমেন্টের হাতে ছেড়ে দিন। ঘরে ঘরে বার্তা পাঠান দুই ঘরে আলাদা আলাদা এসি না চালিয়ে সম্ভব হলে এক ঘরে এক এসিতে চারজন কাজ করুন, একই কথা ফ্যানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; কাজ না থাকলে বাতি নিভিয়ে রাখুন।

কারখানায় যান্ত্রিক দক্ষতা বাড়ান, ভবনের নকশা এমন করুন যাতে স্বাভাবিক আলো ও বাতাস বয়, সার্বিকভাবে জ্বালানি-দক্ষতার প্র্যাকটিস করুন, ইজিবাইক চার্জিং ব্যবস্থাকে বিলের আওতায় আনুন, দেশি কয়লা ব্যবহারের ব্যবস্থা করুন, সৌরশক্তি দিয়ে কৃষিখেতে সেচ করুন, ডিমের ইনকুবেশন এবং শস্য ও ফসলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে সোলারের ব্যবহার বাড়ান। ছোট ছোট কাজে শক্তির দক্ষ প্রয়োগ হলে দিনশেষে লোডশেডিং লাগবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত