ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আর কী করা যায়

ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আর কী করা যায়

কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান কর্মসূচির সফলতা এবং স্বাস্থ্য পরিসেবার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। কিন্তু একটি কাঠামোগত সংকট রয়েই গেছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে প্রকট বৈষম্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জনের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আমাদের সামনে এই বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে এবং স্পষ্টভাবে গ্রাম ও শহরের জন্য অভিন্ন মডেলের দুর্বল দিকগুলো সামনে হাজির করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের মতো কাঠামো থাকলেও এই সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এক্সেস এখনও অনেক বড় বাধা হিসেবেই রয়েছে। যদিও সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, বাস্তবতা হলো অনেক ক্লিনিকে পর্যাপ্ত জনবল নেই, ওষুধ অপ্রতুল এবং প্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক সেবা অনুপস্থিত। এছাড়া অনেক জায়গায় বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় অবকাঠামো এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে রোগীরা জরুরি ও জটিল সেবার জন্য উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না বা দেরিতে পৌঁছান যা পরিস্থিতিতে আরও কঠিন করে তোলে। তবে গ্রামীণ এলাকায় একটি তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী কাঠামো এরইমধ্যে গড়ে উঠেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি পরিপূর্ণ চেইন এখানে কাজ করছে। এই কাঠামোর দুর্বলতা প্রধানত ব্যবস্থাপনাগত। অনুপযুক্ত তদারকি, দুর্বল জবাবদিহিতা, মনিটরিং ব্যবস্থার ঘাটতি এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার অভাব বিদ্যমান শক্তিশালী অবকাঠামোর কার্যকারিতা ব্যাহত করছে। স্বাস্থ্য কমিশনের মতে, এই কাঠামোকে কার্যকর করতে হলে কর্মীদের পারফরম্যান্সভিত্তিক প্রণোদনা দিতে হবে, ই-হেলথ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে উপস্থিতি ও সেবার গুণমান তদারকি করতে হবে এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সেটা কতটুকু সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে, শহুরে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সমস্যা একেবারেই ভিন্ন। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, বৈষম্য প্রকট এবং রোগের প্রকৃতিও ভিন্ন। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষত বস্তিবাসীরা অনেক সময়ই সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকেন। বেশিরভাগই অপ্রশিক্ষিত ও অনানুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর ওপর নির্ভর করেন। আর এতে অনেক সময় অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে যায়। কারণ এই ধরনের সেবার মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অপরদিকে, উচ্চবিত্তরা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ফলে শহরে একটি দ্বৈত স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো গড়ে উঠেছে।

এই বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ শহরের স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনার দ্বৈত প্রশাসনিক কাঠামো। শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই বিভাজনের ফলে নীতিনির্ধারণ, বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য কমিশনের মতে, এই দ্বৈত কাঠামোকে সরলীকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। হয় শহরের স্বাস্থ্যসেবাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অধীনে আনতে হবে, নয়তো সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি যৌথ, স্বচ্ছ সমন্বয় কাঠামো গঠন করতে হবে।

যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার মতো জেনারেল প্র্যাকটিশনার-নির্ভর রেফারেল সিস্টেমের চিন্তা করা যেতে পারে, যেখানে একজন চিকিৎসক রোগীকে প্রাথমিকসেবা দেবেন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করবেন। এই মডেল কিছু দেশের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও বাংলাদেশে এর বাস্তবায়ন সহজ নয়। একে সফল করতে হলে একটি সুসংগঠিত, প্রশিক্ষিত এবং বিশ্বস্ত প্রাথমিক সেবাপ্রদানকারীদের নেটওয়ার্ক প্রয়োজন আর আমাদের দেশে করা বেশ কঠিন হবে বলে প্রতীয়মান হয়। অধিকাংশ রোগী সরাসরি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন, প্রাথমিক পরিচর্যার প্রতি আস্থা কম এবং ব্যক্তিগত জিপি রাখার ধারণা মেনে নিতে বেশ সময়ও লাগতে পারে। তাই এটা দীর্ঘমেয়াদের ভালো ফল দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও স্বল্প মেয়াদের জন্য বিকল্প ভাবনাও রাখতে হবে। তদুপরি, দেশে ফ্যামিলি মেডিসিন বা জিপি প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে এবং বর্তমান মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন ধরনের চিকিৎসকদের উপযুক্তভাবে তৈরি করার কাঠামো অনুপস্থিত। ফলে এই ধরনের মডেল চালুর আগে চিকিৎসা শিক্ষার সংস্কার ও একটি জবাবদিহিমূলক তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য কমিশনের মতে, বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে বিদেশি মডেল আমদানি করলে তা ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচিত নিজের বাস্তবতা ও সক্ষমতার আলোকে সংস্কার গ্রহণ করা। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মডেল সফল হয়েছে। সেগুলো থেকে আমাদের দেশের বাস্তবতার নিরিখে যেগুলো বিবেচনা করা যায়, সেগুলো নিয়ে ভাবনা শুরু করতে হবে। যেমন- ব্রাজিলের ফ্যামিলি হেলথ স্ট্র্যাটেজি, যেখানে এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্য টিম গঠন করা হয়; ভারতের জাতীয় নগর স্বাস্থ্য মিশন, যেখানে শহরের বিশেষ চাহিদাকে স্বীকৃতি দিয়ে আলাদা কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে এবং থাইল্যান্ডের জেলা স্বাস্থ্য বোর্ড মডেল, যেটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে—এই সব মডেল বাংলাদেশকে চিন্তার খোরাক দিতে পারে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন এমন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশেও কার্যকর, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাম্যভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাদের মতে, জেলা পর্যায়ে পরিকল্পনার স্বাধীনতা থাকতে হবে, যাতে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র বার্ষিক পরিকল্পনা করা যায়। বাজেট বরাদ্দে নমনীয়তা থাকতে হবে, যাতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া যায়। শহর ও গ্রামের ভিন্ন বাস্তবতা অনুযায়ী ভিন্ন কৌশল- কিন্তু একটি জাতীয় কাঠামোর ভেতরেই গ্রহণ করাটাই হবে ভবিষ্যতের পথ। তবে তার আগে ম্যানেজারদের সক্ষমতা তৈরি করা ও জবাবদিহিতার বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক মানবাধিকার হলেও, সেই অধিকার বাস্তবায়নের উপায় ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে বাধ্য। শহর ও গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যকে স্বীকার করে হস্তক্ষেপ গ্রহণ না করলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ শুধু একটি রূপকল্প হিসেবেই থেকে যাবে।

ড. শাফিউন নাহিন শিমুল অধ্যাপক

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত