জুলাই বিপ্লবে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঝাঁপিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা। ভোটাধিকারসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকা। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে গিয়ে বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। কিন্তু মানুষের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা নির্বাচন বা ভোটাধিকার প্রয়োগের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস অতিবাহিত হলেও এখনও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি। সুস্পষ্ট কোনো ধারণাও পাচ্ছে না দেশের মানুষ। বরং যত দিন যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে তত বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। ফলে রাজনীতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সমালোচনা ও বিতর্ক বাড়াচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ঐক্যের বদলে রাজনীতির মাঠে অনৈক্যের সুর ক্রমে তীব্র হচ্ছে। দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যেসব দল শামিল থেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, জুলাই বিপ্লবকে সফল করেছে, তারাই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছে। দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়ছে। পরস্পরের ত্রুটি অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই ত্রুটি অন্বেষণ অনেক ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের গণ্ডিও মানা হচ্ছে না। ফলে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণই দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। কয়েকটি দল বলছে সংস্কারের পরই হবে নির্বাচন। কিন্তু সংস্কারের কাজ কতটা এগিয়েছে, তা নিয়েও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে নির্বাচন দাবি করা কোনো কোনো দলের পক্ষে এমনও বলা হচ্ছে যে, সংস্কারের বাহানায় সরকার কালক্ষেপণ করছে। নির্বাচন পিছিয়ে নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে চাইছে। আবার কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করছে। এসবই নিজেদের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধির বড় কারণ হচ্ছে। পাশাপাশি মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের অবস্থানের সমালোচনা, পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যর্থতা, অর্থনীতিতে অস্বস্তি, কোনো কোনো উপদেষ্টার কিছু মন্তব্য, এমনি আরও কিছু বিষয়ও অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৯০ দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সরকারেরও নির্বাচন অনুষ্ঠানে ৯০ দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা সরকারের কাছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছি। এই নির্বাচনের জন্য আমাদের বহু নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন, গুম হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এটি মানুষের রাজনৈতিক অধিকার।’ নির্বাচন কমিশনও বলেছে, তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছে। তার পরও কেন নির্বাচন নিয়ে এমন অস্পষ্টতা, তা বোধগম্য নয়। নির্বাচনের দিনক্ষণ স্পষ্ট না করায় তা মানুষকে ক্রমেই সন্দিহান করছে, ক্ষুব্ধ করছে। আমরা মনে করি, দ্রুত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা প্রয়োজন। কারণ, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ নানা ক্ষেত্রেই সংকট তীব্র হচ্ছে। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, উত্তেজনা তত বৃদ্ধি পাবে। দেশে আবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। তেমন পরিস্থিতি আমাদের কাম্য নয়।