বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক গভীর সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং অনেকেই আর দেশে ফিরছে না। এই মেধাপাচার বা ব্রেইন ড্রেইন বর্তমানে কেবল ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের অংশ নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির জন্য বড় হুমকি। একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি তার তরুণ মেধাসম্পদ। যখন সেই মেধা দেশ ছেড়ে অন্য দেশের জন্য কাজ করতে শুরু করে, তখন দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যায়, ভর করে স্থবিরতা। বিদেশে পড়তে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক বাস্তব কারণ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা পরিবেশ অত্যন্ত দুর্বল ও সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং তা শুধুই ডিগ্রি অর্জনের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে থেকে যায়। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব। সেখানে রয়েছে আধুনিক ল্যাব, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, দক্ষ গাইড এবং একটি সৃজনশীল পরিবেশ, যা একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত অনুকূল। ফলে নিজের প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে বিদেশই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা।
আরেকটি বড় কারণ হলো দেশে মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। উচ্চশিক্ষা শেষ করেও অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে পেশাগত জীবনে অবমূল্যায়নের শিকার হতে হয়। কর্মসংস্থান খাতে রাজনৈতিক পরিচয়, সুপারিশ কিংবা দুর্নীতির কারণে অনেকেই পিছিয়ে পড়েন। অন্যদিকে, বিদেশের চাকরি বাজারে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানজনক কর্মসংস্থান পাওয়া সম্ভব হয়। ফলে একবার বিদেশে গিয়ে তারা আর ফিরে আসতে চান না। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিরক্ত করে তোলে। অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখল হয়ে পড়ে ছাত্র রাজনীতির হাতে। পাঠদানের সঠিক পরিবেশ নষ্ট হয়, সেশনজট তৈরি হয়, ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। অপরদিকে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার গতি ও গুণগত মান এমন যে, সেখানে একজন শিক্ষার্থী পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজের জীবন গড়তে পারে। আরেকটি বাস্তব সমস্যা হলো পর্যাপ্ত স্কলারশিপ ও আর্থিক সহায়তার অভাব। উন্নত দেশগুলো সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উদারহস্তে বৃত্তি ও বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এই সুযোগ সীমিত, বিশেষত গবেষণা ক্ষেত্রে। ফলে অনেকে বিদেশের স্কলারশিপ পেলে তা গ্রহণে দ্বিধা করেন না। আমাদের দেশের পাঠ্যক্রম এখনও অনেক ক্ষেত্রে সময়ের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ায় আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে যুগোপযোগী জ্ঞান ও দক্ষতায়। ফলে তারা নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে বিদেশে যেতে বাধ্য হয়।
এই ব্রেইন ড্রেইনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এখনই শিক্ষাব্যবস্থায় সময়োপযোগী সংস্কার আনা জরুরি। গবেষণায় অধিক বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি থেকে মুক্তি এবং চাকরি বাজারে মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা যে, বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। রাষ্ট্র যদি এই বিশ্বাস ও পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে, তবে মেধাবীরা আর বিদেশমুখী হবে না- বরং নিজের দেশেই গড়বে নতুন দিগন্ত, উন্নয়নের এক অপ্রতিরোধ্য পথ। শিক্ষার্থী: ঢাকা কলেজ, ঢাকা।