ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বারবারের বন্যা : টেকসই বাঁধ ও আগাম সতর্কতাই হতে পারে উত্তরণ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বারবারের বন্যা : টেকসই বাঁধ ও আগাম সতর্কতাই হতে পারে উত্তরণ

বাংলাদেশ প্রকৃতিগতভাবেই বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি। ঝড়-জলের সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেড়ে ওঠা। নাতিশীতোষ্ণ এই দেশে বছর ঘোরে ছয় ঋতুর দোলাচলে। তবে এখন ষড়ঋতুর দেখা আর না মিললেও গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতের পরিধি ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে আরোপিত কিছু ভোগান্তিও। গ্রীষ্মে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রচণ্ড তাপ, বর্ষায় দুর্নীতি আর কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফাঁদে জলাবদ্ধতাণ্ডবন্যা, আর শীতে জলবায়ু ইস্যুতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ-এর সঙ্গেই বসবাস আমাদের। আর বাংলাদেশ এক নদীমাতৃক দেশ, যার গা দিয়ে বয়ে চলেছে প্রায় ২৭-এর বেশি নদনদী। এই নদীগুলোর উপচেপড়া পানি, বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি এবং হিমালয় থেকে নেমে আসা উজানের স্রোতের কারণে প্রতি বছরই দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। বন্যা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের একটি বাস্তবতা, যা অনেক সময় আশীর্বাদ হিসেবে কৃষির জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখলেও, তা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়, তখন তা মানুষের জীবন, জীবিকা এবং অর্থনীতির উপর গভীর আঘাত হানে। বিগত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি, বন্যার প্রকোপ বেড়েছে এবং এর ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে উঠেছে আরও ভয়াবহ। এমতাবস্থায়, শুধু আপৎকালীন ত্রাণ নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান। এর জন্য সবচেয়ে জরুরি দুটি দিক হলো- টেকসই বাঁধ নির্মাণ এবং আগাম প্রস্তুতির কার্যকর উদ্যোগ।

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট : প্রাকৃতিক গঠনের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বন্যাপ্রবণ দেশ। প্রতিবছর গড়ে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা স্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়ে। তবে ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০১৭, ২২,২৩,২৪ সালের মতো ভয়াবহ বন্যায় এই পরিমাণ বেড়ে ৬০%-৭০% পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এসব বন্যা কোটি কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন হয় এবং হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৯৮ সালের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ছিল প্রায় ৭০ দিন এবং দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ওই বন্যায় প্রায় ৩ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। শুধু ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিই নয়, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন ব্যবস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বন্যার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, নদীর নাব্যতা হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার ভরাট, দুর্বল বাঁধ অবকাঠামো, বিদ্যমান বাঁধ অবকাঠামোর দুর্বলতা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭,০০০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নির্মিত এবং দীর্ঘ সময় ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বাঁধেই ফাটল ধরেছে, কিছু বাঁধ ভেঙে পড়েছে এবং অনেক বাঁধ অবৈধ দখলের শিকার।

এই বাঁধগুলো নির্মাণের সময় যথাযথ পরিকল্পনা, গুণগতমানের নির্মাণসামগ্রী এবং স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, ঠিকাদারি সিন্ডিকেট এবং দুর্নীতির কারণে বাঁধ নির্মাণের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে বন্যার সময় এসব বাঁধ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।

টেকসই বাঁধের প্রয়োজনীয়তা : বাঁধ শুধু পানি ঠেকানোর উপকরণ নয়, এটি একটি সামগ্রিক প্রতিরোধব্যবস্থা- যা শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষকেই রক্ষা করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কৃষিকাজকে সচল রাখতে সহায়তা করে। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাঁধ নির্মাণে কিছু বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে : ১. উন্নত মানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার দীর্ঘস্থায়ী বাঁধের জন্য শুধুমাত্র কাদা-মাটি বা নিম্নমানের ইট নয়, প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন- জিও টেক্সটাইল, কংক্রিট ব্লক, নদীতীর সংরক্ষণ পাইলিং ইত্যাদি।

২. প্রকৌশলগত ডিজাইন ও পরিবেশবান্ধব পন্থা : প্রকৃতপক্ষে বাঁধ নির্মাণে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। বাঁধের উচ্চতা, প্রস্থ, স্লোপ এবং নদীর গতিপথ বিবেচনায় নির্মাণ করতে হবে যাতে তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত না করে।

৩. স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা : যেকোনো বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সফলতানির্ভর করে স্থানীয় জনগণের সহায়তা ও সচেতনতার উপর। স্থানীয় পর্যায়ে বাঁধ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে তারা যাতে রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. বাঁধের উপর বৃক্ষরোপণ ও প্রাকৃতিক বাধা সৃষ্টি : বাঁধের দুই পাশে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ যেমন- বাঁশ, বেত, তাল ইত্যাদি রোপণ করলে তা মাটি ধস রোধে সাহায্য করে এবং বাঁধকে আরও দৃঢ় করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত