নৈতিক আলোচনায় কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতনতা ও মর্যাদার দাবি রাখে। ‘হলোকাস্ট’ হলো তেমনই একটি শব্দ। এটি শুধুমাত্র গণহত্যার বর্ণনা নয়; এটি একটি গভীর নৈতিক অভিযোগ একটি জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য পদ্ধতিগত, আমলাতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত এবং আদর্শভিত্তিক প্রচেষ্টার প্রতীক। এই শব্দটি শুধু বিপর্যয় নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, শিল্প-পর্যায়ের মাপকাঠিতে মন্দ চিত্র বহন করে। হালকাভাবে এই শব্দ ব্যবহার ইতিহাসকে অসম্মান করে; আবার, বর্তমান সময়ে এর প্রতিধ্বনি উপেক্ষা করাও বর্তমানকেই অসম্মান করার শামিল। এবং এখানেই এসে দাঁড়ায় গাজার প্রসঙ্গ- অস্বস্তিকর, কিন্তু অপরিহার্যভাবে।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ৬০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই হলো সাধারণ নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১,২১,০০০ এর বেশি। হাসপাতালগুলো পরিণত হয়েছে মৃতদেহের স্তূপে। স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র, বেকারি, এমনকি গোটা আবাসিক এলাকাগুলো বোমায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। খাবার এতটাই দুর্লভ হয়ে পড়েছে যে, জাতিসংঘ পর্যন্ত ব্যাপক দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা জানিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, মার্চ, ২০২৫ পর্যন্ত ৩২৬ জন মানুষ এরইমধ্যে ক্ষুধায় মারা গেছেন তাদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে।
এটি কোনো দুর্বল সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের উপসর্গ নয়। এটি ইচ্ছাকৃত নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিণতি। ইসরায়েলি নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, মানবিক সহায়তা আটকে রাখার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ছাড় আদায়ের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারাও এই অবরোধকে কৌশলগত ভাষায় বর্ণনা করেছেন- নিরাপত্তার অনিবার্য প্রয়োজন হিসেবে নয়, বরং একটি চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে। যখন কোনো সংঘাতে এক পক্ষ পদ্ধতিগতভাবে অন্য পক্ষের খাদ্য, ওষুধ ও পানি অস্বীকার করে, তখন সেটি আর প্রচলিত যুদ্ধের সীমার মধ্যে থাকে না। তখন সেটি হয়ে দাঁড়ায় সমষ্টিগত শাস্তি।
তবুও, এখনও অনেকেই এই তুলনায় অস্বস্তি বোধ করেন- কেউ গাজার পরিস্থিতিকে কীভাবে হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করতে পারে?
প্রশ্নটি যথার্থ। নাৎসি হলোকাস্ট ছিল তার ব্যাপ্তি ও যান্ত্রিকতার দিক থেকে অনন্য। গাজায় কোনো দাহ্যচুল্লি বা গ্যাসচেম্বার নেই। কিন্তু এই তুলনার উদ্দেশ্য পদ্ধতির মিল নয়, বরং নৈতিক সাদৃশ্যতা। হলোকাস্ট শুধুমাত্র তার প্রযুক্তিগত কায়দা দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয়নি; এটি ছিল এক নির্মূলকরণ তত্ত্বের প্রতিফলন- এমন একটি যুক্তি, যার লক্ষ্য ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে কেবল কোনো এলাকা থেকে নয়, বরং ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই যুক্তির শুরু অ্যাউশভিৎস থেকে নয়। এর শুরু হয়েছিল ঘেটো থেকে, অনাহারনীতি থেকে, নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক করে তোলার মধ্য দিয়ে, আর দর্শকদের নৈতিক অসংবেদনশীলতা থেকে।
এই যুক্তির পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখতে পাচ্ছি। এটি স্বস্তিকা চিহ্ন ধারণ করে আসে না। এটি আসে জাতীয় নিরাপত্তা বা সন্ত্রাসবিরোধী ভাষার আবরণে। এটি প্রকাশ পায় চিকিৎসা অবকাঠামোর ধ্বংস, ৮০ শতাংশ মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং নবজাতকদের অনাহারে মৃত্যুর মাধ্যমে। এটি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের স্লোগানে নয়, বরং শান্ত স্বীকারোক্তিতে কথা বলে- যেখানে দুই মিলিয়ন মানুষের জীবন একটি বৃহত্তর সামরিক কৌশলের ‘আনুষঙ্গিক ক্ষতি’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাহলে এটা কি গণহত্যা? এটি একটি আইনি পরিভাষা, এবং আদালত নিশ্চয়ই তাদের সিদ্ধান্ত দেবে। কিন্তু রায় ঘোষণার অনেক আগেই গণহত্যা শুরু হয়। এটি শুরু হয় যখন রাজনৈতিক নেতারা একটি সম্পূর্ণ জনসমষ্টিকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটি জনপ্রিয়তা পায় যখন যুদ্ধ আর শাস্তির মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। এর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায় যখন পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, আর বিশ্ব এটিকে একটি ‘দুঃখজনক প্রয়োজনীয়তা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
যারা ৭ অক্টোবরের হামলাকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধ হিসেবে তুলে ধরেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায়; হ্যাঁ, সেই হামলা ছিল বর্বর। ১,২০০ ইসরায়েলির হত্যা, বেসামরিক মানুষদের অপহরণ, যে মানসিক ক্ষত সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে- এসব নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার ও দায়িত্ব- উভয়ই আছে।
কিন্তু আত্মরক্ষার সীমা আছে- আইনি, নৈতিক ও বাস্তবিক। আত্মরক্ষা যখন প্রতিশোধে রূপ নেয়, তখন তা নৈতিক সীমা অতিক্রম করে। যখন বেসামরিক মানুষ সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তখন আইনি সীমা অতিক্রম করে ফেলে। আর যখন সামরিক অভিযান এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেখানে মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন বাস্তবিক সীমা লঙ্ঘিত হয়।
এই ব্যর্থতা ইসরায়েলের একার নয়। যুক্তরাষ্ট্র, একদিকে মানবিক সহায়তা দিলেও, অন্যদিকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। তারা একাধিক জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করেছে, আন্তর্জাতিক তদন্তে বাধা দিয়েছে, এবং বিশ্বাসযোগ্য যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ থাকার পরও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছে। এটি কেনো ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নয়; এটি একটি কৌশলগত প্রশ্রয়, যা মিত্রতার মুখোশ পরে এসেছে।
ইউরোপের অবস্থান কিছুটা ভালো, তবে তা খুব সীমিতভাবে। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে কিছু দ্বিপাক্ষিক আলোচনা স্থগিত করেছে, কিন্তু কোনো দেশই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেনি বা জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এই একই সরকারগুলোই প্রতি বছর ২৭ জানুয়ারি বিশ্বকে হলোকাস্ট স্মরণ করার আহ্বান জানায়, অথচ তারা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট সতর্কবাণীটি- জুলুমের মুহূর্তে নীরবতা মানেই জালিমের সঙ্গে অংশীদার হওয়া।
এমনকি আরব বিশ্ব, যারা প্রায়শই ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজেদের স্বঘোষিত মুখপাত্র হিসেবে দাবি করে, তারাও কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মিশর ত্রাণ সহায়তার প্রবেশ সীমিত করেছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো কিছু অর্থ সাহায্য দিয়েছে, কিন্তু কার্যকর চাপ প্রয়োগে আগ্রহ দেখায়নি। তখন প্রশ্ন ওঠে: যখন পশ্চিমা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহদের তুলনায় অধিক নৈতিক সাহস দেখায়, তখন আঞ্চলিক ঐক্যের তাৎপর্য আদৌ কী থাকে?
এসব বক্তব্যের কোনোটাই হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদি জনগণের ট্রমাকে অস্বীকার করা বা ইতিহাস বিকৃত করার উদ্দেশ্যে নয়। বরং এর ঠিক বিপরীতটাই সত্য- গাজাকে ঘিরে হলোকাস্টের উদাহরণ টানার অর্থ হলো, এই জোর দিয়ে বলা যে ‘আর কখনো নয়’ স্লোগানটি যেন সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য হয়- শুধু ইহুদিদের জন্য নয়, শুধু ইউরোপিয়দের জন্য নয়, শুধু তাদের জন্য নয় যাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক।
যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহার, পানিশূন্যতা ও বিমান হামলার মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যার ফলাফল হয় সাধারণ মানুষের ব্যাপক মৃতু-আর সেটাও যদি আমাদের নৈতিক ক্ষোভ জাগাতে না পারে, তাহলে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, আমরা আদৌ ‘নৃশংসতা’ বলতে কী বুঝি? যদি গণহত্যাকে শুধু ১৯৪৪ সালের পোল্যান্ডের সঙ্গে মিললেই গণহত্যা হিসেবে গণ্য করি, তাহলে আমরা আসলে তার কাছ থেকে কিছুই শিখিনি। গণহত্যার রূপ পাল্টায়। তা সময়ের হাতিয়ার অনুযায়ী নিজেকে রূপান্তরিত করে। আজকের দিনে নিশ্চিহ্নকরণ কার্যক্রমে গ্যাস চেম্বার থাকতেই হবে- এমন কোনো কথা নেই। এটি চলতে পারে অবরোধ, বোমাবর্ষণ এবং আমলাতান্ত্রিক অচলতার মাধ্যমে।
অনেকে আপত্তি তুলবেন যে ‘হলোকাস্ট’ শব্দটি পবিত্র এবং তা অযাচিত ব্যবহার করে হালকাভাবে কিছু বোঝানো উচিত নয়। সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যদি কোনো শব্দের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা আমাদের সেই শব্দের নতুন রূপে ফিরে আসাকে চিনে উঠতে না দেয়, তবে সেই শ্রদ্ধাই এক ধরনের অন্ধতা হয়ে দাঁড়ায়। শব্দ হলো একটি হাতিয়ার। তার শক্তি টিকে থাকে সংরক্ষণে নয়, প্রাসঙ্গিকতায়।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইসরায়েলকে মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে নির্দেশ দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্যাতনের নথি সংগ্রহ করছে। নাগরিক সমাজ বিশ্বব্যাপী সংগঠিত হচ্ছে। এগুলো আশার ইঙ্গিত কিন্তু যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে জরুরি তা হলো নীতিগত পদক্ষেপ- অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ, আইনি জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা যা গাজাকে ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়ের পরবর্তী টীকা হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করতে পারে।
এটি পক্ষ বেছে নেওয়ার ব্যাপার নয়; এটি নীতি ও মানদ- বেছে নেওয়ার প্রশ্ন। আমরা হয় সর্বজনীন মানবাধিকারে বিশ্বাস করি, নইলে কোনো অধিকারেই বিশ্বাস করি না। ‘আর কখনও নয়’- এটি হয় একটি নীতিগত অঙ্গীকার, নয়তো একটি খালি স্লোগান মাত্র।
হলোকাস্ট অবশ্যম্ভাবী ছিল না। তা ঘটেছিল কারণ পৃথিবী নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছিল যে, এক জাতির যন্ত্রণা আরেক জাতির শান্তির মূল্য হতে পারে। সেই মিথ্যাই আজ আবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। এখন গাজা বোমার আগুনে পুড়ছে। এবং সম্ভবত আমাদের জন্যও প্রমাণ করার এটাই শেষ সুযোগ- ইতিহাস আমাদের কিছু শিখিয়েছে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক